ষ্টাফ রিপোর্টার ॥
জাল জালিয়াতিসহ দুর্নীতি বন্ধ হচ্ছে না লালমনিরহাটের নিকাহ রেজিষ্ট্রার ও সাবরেজিষ্ট্রার অফিসগুলো ।সম্প্রতি এতদ সংক্রান্ত বিস্তারিত খবর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত হওয়ার পর জেলাজুড়ে তোলপাড় অবস্থার সৃষ্টি হওয়ার পাশাপাশি দুর্নীতির সাথে জড়িতরা চরম ক্ষুব্দ হয় এবং সাংবাদিক সম্পর্কে বিষদগার করেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলা রেজিষ্ট্রার লুৎফুল কবীর প্রতিটি সাবরেজিষ্ট্রারের নিকট থেকে মাসিক মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে থাকেন। যা প্রতি মাসের থেকে ১০ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট অফিসের অফিস সহকারীরা তাকে দিয়ে যান বলে একটি বিশ^স্ত সুত্রে জানা গেছে। ইতোমধ্যে একাধিক সাংবাদিক দলিল লেখক ও সাবরেজিষ্ট্রারের দুর্নীতির বিস্তারিত তথ্য বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাসহ ফেসবুকে উল্লেখ করেছেন। তারা জমির শ্রেণী পরিবর্তনসহ হেবার মাধ্যমে এবং বিভিন্ন কায়দায় সরকারকে কোটি কোটি টাকা রাজস্ব ফাঁকি দিয়ে ওই টাকা তারা সকলে মিলে ভাগবাটোয়ারা করে নিচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে।সাবরেজিষ্ট্রারগন প্রতিদিন শুন্য হাতে অফিসে আসে আর বাড়ি ফেরার সময় ব্যাগ ভর্তি টাকা নিয়ে যায়। যা দুর্নীতি দমন কমিশনের কর্মকর্তারা তাদেরকে নজরদারীতে রাখলে এবং তাদের ব্যাগ বা দেহ তল্লাশী করলে ঘুষ বানিজ্যের টাকার সত্যতা পাওয়া যাবে বলে অনেকেই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।প্রতিটি সাবরেজিষ্ট্রার অফিসের ক্যারানিদের মাধ্যমে দলিল লেখকরা তাদের ভাগের টাকা প্রদান করে থাকেন। যা আদিতমারী সাবরেজিষ্ট্রার অফিসে গিয়ে ক্যারানি আইয়ুব আলী ও সদর সাবরেজিষ্ট্রার আলহাজ্ব ফাতেমা বেগমের নামে শামসুল ওরফে কালা শামসুল হকের টাকা কালেকশন করার দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করা গেছে। তিনি ওই অফিসের সাবরেষ্ট্রিার কামরুল ইসলামের টাকা কালেকশন করছেন প্রকাশ্যই।এভাবে প্রতিটি অফিসের ক্যারানিররা প্রতিটি সাবরেজিষ্ট্রারের ঘুষের টাকা কালেকশন করে থাকেন। এতদ সংক্রান্ত খবর সাপ্তাহিক বাংলার সংবাদ পত্রিকাসহ বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। কিন্ত কোন সংস্থাই এদের দুর্নীতি ও ঘুষ বানিজ্যের বিষয়টি তদন্ত করেনি। একারনে তারা বীরদর্পে তাদের অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে।পরের সংখ্যায় সাবরেজিষ্ট্রারদের ও তাদের অফিসের সমস্ত দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরা হবে। এদিকে দেখা গেছে,বছর কয়েক আগেই লালমনিরহাট জেলাকে বাল্যবিয়ে মুক্ত ঘোষনা করা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে জেলায় বহুগুনে বেড়েছে বাল্যবিয়ের প্রবনতা। কলেজে ওঠাতো দুরের কথা ৮ম শ্রেণি পাশ না করতেই স্বামীর সংসারে যেতে বাধ্য হচ্ছে এ অঞ্চলের কিশোরী মেয়েরা। এ কাজে ছাত্রীর পরিবারের চেয়ে ঘটক ও নিকাহ রেজিষ্ট্রাররা বেশি আগ্রহী বলে দাবি স্থানীয়দের। ইতিপূর্বে বাল্যবিয়ের দায়ে ভ্রাম্যমান আদালতে অনেকের জেল জরিমানাও হয়েছে। কারাদন্ড থেকে বাঁচতে পারেনি নিকাহ রেজিষ্ট্রার কাজিরাও। সাম্প্রতিক সময়ে বাল্যবিয়ে নিরোধে প্রশাসনের তেমন একটা হস্তক্ষেপ না থাকায় জেলায় বাল্যবিয়ের হিরিক পড়েছে বলে স্থানীয়দের দাবি। ২০১৪ সালে ৩০ নভেম্বর ৮ম শ্রেনীর ছাত্রীর বাল্যবিয়ে রেজিষ্ট্রির প্রস্তুতি নেয়ার অপরাধে দলগ্রাম ইউনিয়নের নিকাহ রেজিষ্ট্রার কাজি আবু হানিফকে এক মাসের বিনাশ্রম কারাদন্ড প্রদান করেন ভ্রাম্যমান আদালতের বিচারক তৎকালীন কালীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) গোলাম রাব্বী। সেই সাথে ওই নিকাহ রেজিষ্ট্রারের লাইসেন্স বাতিলের সুপারিশও করেন তিনি। রহস্যজনক ভাবে সেই চিঠি আজ অবধি লাল ফিতায় বন্দি আছে জেলা রেজিষ্ট্রারের কার্যালয়ে।এতোকিছুর পরও অদৃশ্য শক্তির জোড়ে কাজি আবু হানিফ দেদারছে চালিয়ে যাচ্ছেন বাল্যবিয়ে। গত ১৭মে দলগ্রামে ৯ম শ্রেনীর ছাত্রীর বিয়ের খবরে ভ্রাম্যমান আদালত মেয়ের বাবার এক হাজার টাকা জরিমানা করেন। এর ৫দিন পরই সেই বাল্যবিয়েটিও রেজিষ্ট্রি করেন কাজি হানিফ। গত ১৭ সেপ্টেম্বর দঃ দলগ্রামের ৯ম শ্রেনীর ছাত্রী মারুফার বাল্যবিয়ে রেজিষ্ট্রি করেন তিনি। কাজি হানিফের বড় শক্তি জেলা রেজিষ্ট্রার সরকার লুৎফুল কবির। যেখানে টাকা হলে সাতখুন মাপ। কাজ যাই হোক প্রতিটি কাজিকে বার্ষিক আয়ের ১০/১৫ শতাংশ টাকা উপঢৌকন হিসেবে দিতে হয় জেলা রেজিষ্ট্রারকে। এতে অনেক ভুয়ারাও জাল জালিয়াতি থেকে বেঁচে যান। অন্যথায় হয়রানীর খড়গ নামে বলে একাধিক নিকাহ রেজিষ্ট্রার দাবি করেছেন। শুধু হানিফেই নয়, টাকার বিনিময়ে রাতারাতি নিয়োগও পাচ্ছেন অনেক ভুয়া কাজি। জেলায় বেশ কিছু নিকাহ রেজিষ্ট্রারের লাইসেন্স জাল রয়েছে বলে একাধিক নির্ভরযোগ্য সুত্র দাবি করেছে। পাটগ্রাম পৌরসভার নিকাহ রেজিষ্ট্রার মামুনুর রশিদের লাইসেন্স জব্দ না করেই জাল বলে জেলা রেজিষ্ট্রারের নির্দেশে আদালতে মামলা দিয়েছেন পাটগ্রাম সাব রেজিষ্ট্রার সবুজ মিয়া। মামলায় হাজতবাস করার পর মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে বাদি বিবাদির সমঝোতার ফলে আদালতে উপযুক্ত প্রমানাদি পেশ করেন নি বাদি। ফলশ্রুতিতে জামিনে মুক্তিপান কাজি মামুনুর রশিদ। পাটগ্রাম পৌরসভার নিকাহ রেজিষ্ট্রার কাজি ইউনুস ও কাজি আনোয়ার হোসেন ৩/৪ বছর ধরে বিবাহ রেজিষ্ট্রি করে আসলেও তাদের বৈধ কোন কাগজপত্র নেই। তাদের কোন কাগজপত্র পৌরসভায়ও নেই বলে বিবার্তাকে জানান মেয়র শমসের আলী। জেলা রেজিষ্ট্রার নিজে ওই দুই নিকাহ রেজিষ্ট্রারের নিয়োগ পরীক্ষার কোন দলিল দেখাতে না পারলেও তাদেরকে বৈধ দাবি করেছেন। মোটা অংকের টাকার বিনিময়ে জেলা রেজিষ্ট্রারের নেতৃত্বে আগের তারিখে স্বাক্ষর দিয়ে জালকে বৈধ বানানোর চেষ্টা চলছে। তবে দু’জন সদস্য আগের তারিখে স্বাক্ষরে অসম্মতি জানায় কাজটি সম্পন্ন করতে পারেন নি বলে নির্ভরযোগ্য সুত্রের দাবি। আদিতমারীর দুর্গাপুর ইউনিয়নের ৯ বছরের নিকাহ রেজিস্টার মাহমুদুল হাসানের কাছ থেকে বার্ষিক আয়ের ১০ শতাংশের উপঢৌকন না পাওয়ায় পুর্বের কাজির কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে না নিয়ে তদস্থলে রাতারাতি শরিফুল ইসলাম নামে একজনকে কাজি নিয়োগ দিয়েছেন জেলা রেজিষ্ট্রার সরকার লুৎফুল কবীর। এ নিয়োগ নিয়ে আদালতের স্থগিতাদেশ থাকলেও তা আমলে নেয়া হয় নি বলে জানা গেছে। সারা দেশে নিকাহ রেজিষ্ট্রার নিয়োগে মহামান্য রাষ্ট্রপতির প্রয়োজন না হলেও এই একমাত্র নিয়োগ যেখানে বলা হয় মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশক্রমে এ নিয়োগ দেয়া হলো। কিন্তু ওই শরিফুলের যোগদানপত্র বা তার নিজ নামে নেই রেকান ভলিয়ম বহি, তবুও তিনি বিবাহ রেজিষ্ট্রি করছেন। বর্তমানে এ ইউনিয়নে দু’জনই নিজেকে বৈধ কাজি দাবি করছেন। সবমিলে এ নিয়োগটি নিয়েও প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছেন জেলা রেজিষ্ট্রার সরকার লুৎফুল কবির। তার এ কাজের প্রধান সহায়ককারী তার অফিস সহকারী মনিরুজ্জামান ও জেলা কাজি সমিতির সাধারন সম্পাদক কাজি ফয়সাল। যে অফিস সহকারী মনিরুজ্জামানকে চাকুরী জিবনের ১৩ বছরেও লালমনিরহাটের বাহিরে কেউ বদলী করতে পারেন নি। এতেই শেষ নয়, ভেলাবাড়ি ইউনিয়নের নিকাহ রেজিষ্ট্রার কাজি এজাজুল ইসলাম বিধিবহির্ভূত ভাবে একই সঙ্গে দুই স্থানে সম্মানী ও বেতন ভোগ করছেন। তিনি নিজেও ৯ম শ্রেনির এক ছাত্রীকে বাল্য বিয়ে করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কাজির পাশাপাশি তিনি ভেলাবাড়ি দাখিল মাদরাসার অফিস সহকারী হিসেবে বেতন ভাতাদি ভোগ করছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি আত্মীয় স্বজন ও বন্ধুদের হাতে ভলিয়ম বহি দিয়ে নিকাহ রেজিষ্ট্রি করছেন। যার ফলে এ ভায়া কাজিরা আইনের তোয়াক্কা না করে দেদারচে বাল্যবিয়ে রেজিষ্ট্রি করে যাচ্ছেন। এমন অভিযোগ জেলা কাজি সমিতির সাধারন সম্পাদক কাজি ফয়সালসহ প্রায় ১০/১২জন কাজির বিরুদ্ধে। জেলা কাজি সমিতির সাধারন সম্পাদক কাজি ফয়সাল নিজেকে জেলা রেজিষ্ট্রার সরকার লুৎফুল কবীরের নিজের লোক বলে দাবি করে তিনি জেলার সকল কাজিকে কব্জা করে রেখেছেন। তিনি যখন যাই বলুক তা সকল কাজিকে মেনে নিতে হয়। তা নাহলে তাদের কপালে বাল্যবিাহসহ নানা অভিযোগ নেমে আসে। অথচ তিনি নিজেও গত সপ্তাহে কলেজ বাজার সংলগ্ন এলাকার একটি বাল্যবিবাহ তার বাসায় রেজিষ্ট্রি করেন। এমন ভাবে ভুয়া আর জাল জালিয়াতিতে ভরে উঠেছে নিকাহ রেজিষ্ট্রারের মত গুরুত্বপুর্ন দফতরটি। ভুয়া কাজিরাই গোপনে রাতের আঁধারে বে-সরকারী ভলিয়মে বাল্যবিয়ে চালিয়ে যাচ্ছেন। ফলে স্থানীয় সচেতন মহল বা প্রশাসন চেষ্টা করেও বাল্যবিয়ে থেকে রক্ষা করতে পারছে না স্কুল মাদরাসার শিক্ষার্থীদের। বাল্যবিয়ে মুক্ত এ জেলার অধিকাংশ ছাত্রীর শিক্ষা জিবনের সমাপ্তি ঘটছে জেএসসি পরীক্ষার পর পরেই। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধে বদ্ধ পরিকর উল্লেখ করে জেলা রেজিষ্ট্রার সরকার লুৎফুল কবির বিবার্তাকে জানান, লাইসেন্স জাল প্রমানিত হওয়ায় কাজি মামুনুর রশিদের বিরুদ্ধ মামলা দেয়া হয়েছে, আদালতে প্রমানাদি দাখিলের দায়িত্ব পুলিশের। লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক শফিউল আরিফ বিবার্তাকে জানান, মহামান্য রাষ্ট্রপতির আদেশে দুর্গাপুরে কাজি নিয়োগের বিষয়টি তার জানা নেই, খোঁজ নিয়ে ব্যবস্থা নিবেন বলে তিনি জানান। তবে শারদীয় দূর্গা উৎসবের পরে কাজিদের নিয়ে আলোচনা করে বাল্যবিয়ে রোধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে। প্রয়োজনে এবার বাল্যবিয়ে রেজিষ্ট্রি করা কাজিদের নামে মামলা করা হবে বলেও জানান তিনি।এবিষয়ে বিস্তারিত সংবাদ সাপ্তাহিক বাংলার সংবাদ পত্রিকায় প্রকাশিত হলেও উক্ত শীর্ষ দুর্নীতিবাজ জেলা রেজিষ্ট্রারের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা গ্রহন করা হয়নি বলে জানা গেছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *