আবু সাঈদ
লন্ডনের লর্ডসে বন্ধু প্রিয়জিৎ দেবসরকারের সঙ্গে যৌথভাবে লেখা ‘দ্য কনসার্ট ফর বাংলাদেশ: দুই বন্ধু এক দেশ’ বইয়ের ইংরেজি ভার্সনের প্রকাশনা উৎসবে যেতে চেয়েও যাওয়া হলো না। লন্ডনের সোয়াস অথবা কিংস কলেজের আমন্ত্রণপত্র হাতে পেয়েও শেষমেশ উপস্থিত হতে পারলাম না। একইভাবে কলকাতাও। এর মধ্যে একদিন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এস এ মনসুর আহমদ বলেন, ‘যেখানে যেখানে আমি মুক্তিযুদ্ধের সময় ছিলাম, সেই জায়গাগুলো দেখতে ভারতের আগরতলা যাব। আপনাকে অবশ্যই যেতে হবে।’ হেসে বললাম, ‘আচ্ছা, যাব।’

ঈদের আগে যাওয়ার কথা থাকলেও ব্যস্ততা বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু নাছোড়বান্দার মতো লেগে থাকেন মনসুর আহমদ। তিনি বারবার তাগিদ দিতেই থাকেন। আমার অলসতা ভেঙে ধুম করে একদিন ভিসার আবেদন করলাম। ভাবতে পারিনি, এক দিনের মধ্যে ভিসা হয়ে যাবে। আগে তারিখ নির্ধারিত ছিল ২৬ এপ্রিল শুক্রবার সকাল আটটায়।

যাত্রা শুরু
দেশের বাইরে সফর। তা–ও আবার প্রথমবারের মতো। কেমন উত্তেজনা থাকবে, সেটা একবার ভেবেই দেখুন। এটা–ওটা গোছানো। খুব ভোরে উঠে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন। মা খিচুড়ি রেঁধেছে। কোনোমতো খেয়ে বের হয়ে পড়লাম। মনসুর আহমেদ স্যারের বাসার সামনে। বললাম, আমি বাসার নিচে। ‘ঠিক আছে, আমরা নামছি।’

আমরা তিনজন। আমি, এম এস এ মনসুর আহমদ ও তাঁর স্ত্রী মাহবুবা আহমেদ গাড়িতে কমলাপুরে সাড়ে সাতটায় এলাম। দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে গরমের তাপও বাড়তে থাকে। গাড়ি ছাড়ার সময় ছিল আটটা, সেখানে ৯টা বেজে গেছে খবর নেই। একসময় খবর এল, গাড়িতে ওঠার জন্য। গাড়িতে ওঠার পর জানা গেল, গাড়িতে হাওয়া নেই। এই গাড়ি আর যাবে না, অন্য আরেকটি গাড়ি আসবে। অপেক্ষার পালা শেষে গাড়ি এল। এরপর আমাদের যাত্রা শুরু।
আগরতলায় প্রবেশ
অনেক ঝামেলা পেরিয়ে ৩৮ লাখ জনগণের ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় পৌঁছালাম। এ শহরের রয়েছে অনেক ইতিহাস-ঐতিহ্য। কিরিত বিক্রম কিশোর মানিকয়া বাহাদুর দেবাবর্মা ছিল ত্রিপুরার শেষ রাজা। ১৯৪৯ সালে ভারতের সঙ্গে একত্র হয়ে নতুন রূপে এই রাজ্যের যাত্রা। যাহোক, ইতিহাসে আর না-ই ঢুকি। শহরের পাশে মঠ চৌমুহনী। সেখানকার একটি হোটেল কয়েক দিনের জন্য আমাদের হেতু। ছিমছাম শহর। প্রথমত, ঢাকার মতো এত ব্যস্ততম নগরী মনে হলো না। গাড়ি-ঘোড়া একবারেই কম। রাস্তার দুই পাশে বিশাল বিশাল অট্টালিকা নেই। তবে বিভিন্ন মোড়ে মোড়ে কিংবদন্তির ভাস্কর্য দেখে এত ভালো লাগল, তা বলার ভাষা নেই। ভাস্কর্যে কে নেই! রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, বিদ্যাসাগর, নেতাজি, মহাত্মা গান্ধী প্রমুখ। টমটম করে শহর ঘেঁষে আমরা হোটেলে এলাম। আগেভাগে ঠিক ছিল, আগরতলা প্রেসক্লাবে আমাদের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া। হোটেলে পৌঁছার পর দ্রুত রেডি হয়ে প্রেসক্লাবে। সেখানে চলছে, কাজী নজরুল ইসলামের ১২৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে মৈত্রী সংসদের ২১তম সভা। সভায় একে একে ২৪ সংগঠন থেকে প্রায় ৮০ কর্মী উপস্থিত হলেন। সভা পরিচালনা করছেন মৈত্রী সংসদের সভাপতি দেবব্রত দেবরায়। আর সভাপতিত্বের আসনে বিশিষ্ট সাংবাদিক চিত্রা রায়। তিনি এলাকায় সবার কাছে বেশ জনপ্রিয় ও শ্রদ্ধাভাজন। প্রায় ৫০ বছর ধরে সাংবাদিকতা করেছেন। পরিচিতি পর্ব শুরু। সবাইকে পরিচয় করে দিচ্ছেন সংসদের সভাপতি। আমাদের তিনজনকে সবার পরিচিতি শেষের পর পরিচয় করে দিলেন। এরপর আমাদের যথার্থ সম্মান জানিয়ে উত্তরীয় পরিয়ে বরণ করে নিলেন। সভা চলতে লাগল প্রায় দুই ঘণ্টা। জন্মবার্ষিকীর উদ্‌যাপনের নানা পরিকল্পনা। শুনতে ভালো লাগছিল আমাদের জাতীয় কবিকে নিয়ে তাঁদের ভাবনাগুলো।

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলোর সন্ধানে
প্রথম দিনটি আগরতলায় বরণের মাধ্যমে শেষ হয়। সকালে শুরু মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো খুঁজে দেখা। হোটেলে ইতিমধ্যে হাজির হয়েছেন রম্যলেখক ও মৌমিতা প্রকাশের রাখাল মজুমদার, লেখক ও গবেষক জ্যোতির্ময় দাস। সুন্দর করে ম্যাপিং করে দিলেন রাখাল মজুমদার। আমরা বের হলাম বিশ্রামগঞ্জের সেই মুক্তিযুদ্ধের সময় ফিল্ড হাসপাতালের খোঁজে। আমাদের গাড়িচালক সানু। বেশ শান্ত ছেলে। গাড়ি চলছে। দুই পাশে চোখ পড়ছে শহরের মানুষের জীবন–জীবিকার জন্য ছুটে চলা। স্কুটি চালিয়ে নারী-পুরুষ ট্রাফিক নিয়মকানুন মেনে ছুটছেন আপন কর্মযজ্ঞে। শহর থেকে খানিকটা দূরে গেলে দেখা মেলে দু-একটা বাসগাড়ি। সেই গাড়ির চাকাগুলো নানা রঙে সাজানো। বড় করে লেখা ‘আগরতলা টু বিশ্রামগঞ্জ’। গাড়িতে যেতে যেতে দৃষ্টি পড়ে ‘চড়িলাম’ নামক এক জায়গার নেমপ্লেটের দিকে। সেই লেখা দেখার পর মনসুর আহমদ বলেন, ‘চড়িলামে একটা ক্যাম্প ছিল, সেখানে আমার আব্বা ডেপুটি কমান্ডার ছিলেন। আমাকে তিনি খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছিলেন।’

বিশ্রামগঞ্জ হাসপাতাল
চারদিক সবুজেঘেরা পাহাড়। উঁচু–নিচু পথ। এঁকেবেঁকে সাপের মতো চলছে সড়কপথ। মানুষ নেই বললেই চলে। বিশ্রামগঞ্জের সেই হাসপাতাল খুঁজতে আমাদের একটু বেগ পোহাতে হলো। বিশ্রামগঞ্জে এসে একটা হাসপাতাল দেখতে পাই। সেটা ভেবে আমরা গাড়ি থামাই। তারপর হাসপাতালের ভেতরে ঢুকে জানতে পারি, এটি নয়। এখানে একটু দূরে হাবুল ব্যানার্জি বাগান। তাদের দেখানো পথে আমরা ছুটতে লাগলাম। দুই পাশে লাল মাটির পাহাড় আর সবুজ জঙ্গল। প্রশান্তিতে ভরে ওঠে। মাঝেমধ্যে কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে খুঁজে পাই সেই ঐতিহাসিক হাসপাতাল। বাগানের ভেতরে আম, কাঁঠাল, আনারস, লিচুর গাছ। ভেতরে কয়েকজনকে দেখি, জটলা বেঁধে বসে আছে। তাদের আমরা বলি, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে এখানে যে হাসপাতালটা ছিল, সেটা কোথায়? কেউ বলতে পারল না। একজন ৬০ বছর বয়সী মানুষ এগিয়ে আসেন। নাম শংকর দেবনাথ। তিনি আমাদের নিয়ে যান সেই বাগানের কাছে। আমবাগানের নিচে অসংখ্য আনারসের গাছ। তিনি বলেন, ‘এই যে দ্যাখছেন, এখানেই ছিল সেই হাসপাতাল।’ জায়গাটা দেখতে পেয়ে আমরা খুশিতে মেতে উঠি। মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আহমদের চোখে–মুখে উজ্জ্বল রশ্মি জ্বলজ্বল করতে লাগল। তিনি স্মৃতিচারণা করতে লাগলেন, কীভাবে তিনি এখানে চিকিৎসা দিতেন। তাঁদের সঙ্গে জড়িত ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী, এম এ মোবিন, আখতার আহমেদ, নাজিমুদ্দীন আহমেদ, সিতারা বেগম, পরে যোগদান করেন পদ্ম রহমান প্রমুখ।
একজন তরুণ, নাম অভিজিৎ। বয়স ৩২। বলেন, এখানে যে হাসপাতাল ছিল, তিনি তাঁর দাদা-নানির কাছে শুনেছেন। তাঁরা কয়েকজন আমাদের সঙ্গে ছবি তোলেন এবং মুক্তিযোদ্ধা মনসুর আহমেদের ভিডিও করে রাখেন। এমন একজন বীরকে পেয়ে তাঁরাও আনন্দিত। বিশ্রামগঞ্জে এই হাসপাতালের জায়গায় নেই কোনো স্মৃতিফলক, থাকলে হয়তো এ জায়গাটির গুরুত্ব জানতে পারত প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সেখান থেকে বের হয়ে আমার ছুটলাম মেলাঘর বাজার। মেলাঘর ক্যাম্পের সে জায়গার রক্ষণাবেক্ষণ নেই, গড়ে উঠেছে মানুষের বসতবাড়ি।

দুপুর গড়িয়ে বিকেল। মেলাঘর ছেড়ে আমরা ছুটলাম সোনামুড়া বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে মুক্তিযুদ্ধের সময় মনসুর আহমেদ গাড়িতে উঠে আগরতলায় গিয়েছিলেন। সেটা খুঁজতে খুঁজতে দেখা পাই কুমিল্লার ঐতিহ্যবাহী ননী গোপাল লোধের মিষ্টির দোকান ‘মাতৃভান্ডার’। সোনামুড়ার এই মিষ্টির দোকানটি দেখাশোনা করেন তাঁর বড় ছেলে।

নরসিংগড়ের ভাগলপুর

শহরের মহারাজা বীরবিক্রম কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় দেখার পর আমরা গেলাম ইন্দিরা গান্ধী মেমোরিয়াল হাসপাতালে (আইজিএম হাসপাতাল)। এটির যাত্রা শুরু ১৯০৩ সালে। প্রাচীন ভবনটির একটি অংশ স্মৃতিফলক হিসেবে এখনো দাঁড়িয়ে। এই হাসপাতাল মুক্তিযুদ্ধের সময় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। এরপর আমরা ছুটি নরসিংগড়ের পুরোনো বিমানবন্দরের দিকে। বিমানবন্দরে কিছু সময় কাটানোর পর নরসিংগড় বাজারে। বাজার পেরিয়ে ভাগলপুর। সেখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় একটা প্রাথমিক বিদ্যালয় ছিল। এখন সেটি উচ্চবিদ্যালয়। চারপাশে অনেক কাঁঠালগাছ। উঁচু একটা জায়গায় স্কুলটি। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই স্কুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ক্যাম্প করা হয়। সেই সব দিনের স্মৃতিচারণা করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা এম এস এ মনসুর আহমদ। তিনি বলেন, এখানে তিনি ছিলেন। রমেশ দেব নামের একজন তাঁদের মশারি, বিছানাপত্র দিয়েছিলেন। স্কুলটি বন্ধ থাকায় ভেতরে যাওয়া হলো না। এবার সেই রমেশ দেবের বাড়ি খোঁজার পালা। মনসুর আহমেদের স্মৃতিতে মনে পড়ছে, বাড়িটা এদিকেই ছিল। পাশেই ছিল সীমান্ত। একজনকে জিজ্ঞাসা করেও খোঁজ জানা গেল না। তারপর তাঁর স্মরণ থাকা পথ অনুসরণ করে আমরা এগিয়ে যাই। সামনে এগিয়ে গেলে দেখি, তারকাঁটার প্রাচীর। ঠিক প্রাচীরের সামনে থাকা বাড়িটি রমেশ দেবের। একজনকে অনেক জিজ্ঞাসা করার পর জানা গেল, এই সেই রমেশ দেবের বাড়ি। তিনি এখানে থাকেন না। আগের বাড়িগুলো ভেঙে নতুন একজন বাস করছেন।

শালবাগান

শহরের একটু দূরে শালবাগান। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজনীতিবিদদের অফিস ছিল। সংবাদের জন্য তথ্য সংগ্রহের সুবিধা ভেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রটি বাগাফা থেকে সরিয়ে শালবাগানে স্থানান্তর করা হয়। তখন সেটা ছিল সীমান্তরক্ষীবাহিনীর ৯১ হেড কোয়ার্টাস। এখানে ৮ এপ্রিলে ৪০০ ওয়াট শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার থেকে সান্ধ্য অধিবেশন প্রচার করা হয়। শালবাগানে কেন্দ্রটির সার্বিক সহযোগিতা করেন কর্নেল শঙ্করপ্রসাদ ব্যানার্জি। ৫৩ বছর পর বাগানটি দেখে মনে হয় না যে এখানে এমন একটি ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল।

গোকুলনগর শরণার্থী ক্যাম্প

কসবা বিওপি ক্যাম্পে যাওয়ার সময় দুই পাশে বিশাল বিশাল পাহাড়, রবারের গাছ, শালবাগান ও চায়ের বাগান। চায়ের বাগান দেখে মাহবুবা আহমেদ বলেন, চায়ের কুঁড়ি দিয়ে চানাচুর, মরিচ, পেঁয়াজ তেল দিয়ে মেখে খেতে কী যে অসাধারণ স্বাদ! কথা শেষ হতে না হতেই জ্যোতির্ময় দাস বলেন, ‘এই যে এলাকা দেখছেন, এটা গোকুলনগর। এখানে মুক্তিযুদ্ধের সময় শরণার্থীদের অনেক বড় ক্যাম্প ছিল। সে সময় ত্রিপুরার জনসংখ্যা ছিল ১৫ লাখ, আর পুরো ত্রিপুরায় শরণার্থী ছিল ১৬ লাখ। তখন প্রায় প্রতিটি বাড়িতে ছিল শরণার্থী।’

সন্ধ্যায় আগরতলা প্রেসক্লাবের সভাপতি জয়ন্ত ভট্টাচার্য বলেন, গোকুলনগর শরণার্থী ক্যাম্পে একজনের সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তিনি জানতে পারেন যে এক নারীর স্বামী ক্যাম্পে যাওয়ার পর তিন দিন ধরে তাঁর কোনো খোঁজ নেই। তারপর সবাই চিন্তিত হয়ে পড়েন, ঘটনা কী ঘটল। তিন দিন পর ছেলে–মেয়েদের রেখে সেই মহিলা স্বামীকে খুঁজতে ক্যাম্পে যান। ক্যাম্পের পরিস্থিতি এত বেশি ভয়াবহ দেখে তিনিও সেখানে থেকে যান। বেশ কিছুদিন ফিরে আসার পর বাড়ির সবাই বলতে থাকে, কী হয়েছিল? এত দিন থাকার কারণ কী? সেই মহিলা বলেন, ‘এখানে যে অবস্থা দেখেছিলাম, আমার ছেলে–মেয়েদের দেখার জন্য তো আপনারা আছেন, কিন্তু ওখানে তা নেই। মানুষের যে কী ভয়াবহ কষ্ট! তা দেখে আর ফিরতে পারিনি।’

এমন অজস্র স্মৃতিবিজড়িত এই ত্রিপুরার পথেঘাট। প্রতিটি জায়গায় মনে হবে যেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস লেপটে আছে। তাই তো অনেকই বলেন, ত্রিপুরা হলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর রাজধানী।

রাজপ্রাসাদ উজ্জয়ন্ত

আগরতলায় এসেছি, মহারাজার প্রাসাদ দেখব না, এটা কী করে হয়? রাজপ্রাসাদের নাম ‘উজ্জয়ন্ত’। এখানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য টিকিটের দাম ১০০ রুপি আর স্থানীয় লোকেদের জন্য ৪০ রুপি। টিকিট কেটে প্রবেশ করি। আমাদের সঙ্গে আছেন জ্যোতির্ময় দাস। প্রাসাদটি এখন জাদুঘর। ত্রিপুরার ইতিহাস–ঐতিহ্য এখানে তুলে ধরা হয়েছে। সেই সঙ্গে রয়েছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ইতিহাসের গ্যালারি। সেই গ্যালারিতে দেখতে পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের সময় রবীন সেনগুপ্তের তোলা গুরুত্বপূর্ণ কিছু আলোকচিত্র।

সম্মাননা

আগরতলা প্রেসক্লাবের সভাপতি জয়ন্ত ভট্টাচার্য ও সম্পাদক রমা কান্ত দে উত্তরীয় পরিয়ে আমাদের সম্মাননা জানান। তারপর সভাপতি স্মৃতিচারণা করেন বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরে তাঁর পূর্বপুরুষের ভিটার কথা। সেই গল্প যেন শেষই হতে চায় না। কত্ত কত্ত স্মৃতি! উপস্থিত ছিলেন ‘বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিপুরা’ প্রামাণ্যচিত্রের গবেষক ও সাংবাদিক মানস পাল।

পরদিন দুপুরের বাংলাদেশ হাইকমিশনে আমন্ত্রণ। ভারতের ত্রিপুরায় নিযুক্ত বাংলাদেশের সহকারী হাইকমিশনার আরিফ মোহাম্মদ আমাদের স্মারক দিয়ে সম্মাননা জানান। তিনি বলেন, তাঁর বাবাও বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাবার মুক্তিযুদ্ধের সেই সব স্মৃতি তিনিও সংরক্ষণ করতে চান। আমরা সহকারী হাইকমিশনারকে ত্রিপুরা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত জায়গাগুলো সংরক্ষণের আহ্বান জানালে তিনি আমাদের প্রস্তাবে সম্মতি দেন।

আড্ডা ও নৈশভোজ

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক চিত্রা রায় ও তাঁর স্বামী সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা প্রদ্যুৎ ভৌমিক আমাদের নৈশভোজের নিমন্ত্রণ জানান। আমরা তাঁদের দুইতলা বাড়িতে পৌঁছালাম। বাসার ভেতর প্রবেশ করে দেখি বাংলাদেশ টেলিভিশন দেখছেন প্রদ্যুৎ ভৌমিক। তিনি বলতে শুরু করেন বাংলাদেশের সেই সব দিনের কথা। মনে হলো, শুধু তাঁর দেহখানি আছে আগরতলায় কিন্তু প্রাণ, মন পড়ে থাকে বাংলাদেশের কুমিল্লার সেই জন্মভিটায়। গল্প করতে করতে চিত্রা রায় আমাদের জন্য খাবার প্রস্তুত করে খেতে ডাকলেন। আড্ডায় যুক্ত হন মৈত্রী সংসদের সভাপতি দেবব্রত দেবরায় ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদ রহমান। এ আড্ডা শেষ করে ত্রিপুরা দর্পণের কার্যালয়ে। সেখানে উপস্থিত ত্রিপুরা দর্পণের প্রকাশক ও সম্পাদক সমীরণ রায় ও অক্ষর পাবলিকেশনের প্রকাশক শুভব্রত দেব। তাঁদের সঙ্গে চলে জম্পেশ আড্ডা। নানা ভাবনা যুক্ত হয় এই আড্ডায়। ঘড়িতে তখন রাত ১০টার বেশি বাজে। আড্ডা শেষ করতে হবে। শহর মোটামুটি নীরব তখন। শুভব্রত দেব একটি রিকশা ঠিক করে হোটেলে ফিরি। হোটেলে একদল মানুষ নিয়ে উপস্থিত ছিলেন সংস্কৃতিকর্মী শান্তনু শর্মা।

দেশের ফেরার পালা

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময়কার একটুকরো বাংলাদেশকে যেন আরও বেশি আপন মনে হতে থাকে। ভাষা–সংস্কৃতি সবই এক। মনে বারবার প্রশ্ন জাগে, কেন যে দেশভাগের সময় এটা বাংলাদেশেই থাকল না? মানুষের এত ভালোবাসা আমাদের আবেগাপ্লুত করে তোলে। পরদিন, অর্থাৎ ৩০ এপ্রিল সকাল সাড়ে ৮টায় বাসস্ট্যান্ডে বিদায় জানাতে আসেন রম্যলেখক রাখাল মজুমদার, সস্ত্রীক দেবব্রত দেবরায়। বারবার কানে বাজছিল তাঁদের কথা, ‘আবার আসবেন কিন্তু! যোগাযোগ রাখবেন।’ সত্যি, এমন ভালোবাসায় সিক্ত হয়ে আগরতলায় বারবার না এসে কি পার পাওয়া যাবে!

লেখক: কবি, প্রাবন্ধিক, সংগঠক, সম্পাদক ও প্রকাশক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *