উপলক্ষে লেখক নাজমুল হুদা পারভেজের লেখা
* হামার চিলমারী*-বই থেকে উদ্ধৃত
হাজার বছরের ঐতিহ্য হামার চিলমারীর অষ্টমীর স্নান ও মেলা
রাম- রহিমের চারণ ভূমি – হামার চিলমারী
লেখকঃ নাজমুল হুদা পারভেজ
চিলমারী উপজেলার ইতিহাস অত্যন্ত পুরাতন । সঙ্গত কারণেই এখানকার মানুষের সভ্যতা ও সংস্কৃতি নিয়ে ভাবার ও গবেষণা করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে । চিলমারীর সংস্কৃতির সাথে জড়িয়ে আছে চিলমারীর অষ্টমীর মেলার- প্রাচীন ইতিহাস । রাম-রহিমের সত্যিকারের চারণভূমি এই চিলমারী উপজেলা । ধর্মীয় দিক থেকে অষ্টমীর স্নান হিন্দু সম্প্রদায়ের হলেও, শুরু থেকেই এই মেলাটি জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে মিশে গেছে এই এলাকার সংস্কৃতির সাথে । প্রাচীন বন্দর নগরী চিলমারীর অষ্টমীর স্নান ও মেলা এ এলাকার শুধু হিন্দু সম্প্রদায়ের নয়। চিলমারীর অষ্টমীর স্নান সারা দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের একটি তীর্থ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে । সেই সূত্রধরে বলা যায়, চিলমারীর মাটি পবিত্রতার গর্বে গর্বিত ।
১৮৩৮ ইং সালে “Montgomery Martin ” Eastern Indin Voll-lll, London নামক গ্রন্থে মেজর রেনাইল প্রণীত মানচিত্রের সুত্র ধরে চিলমারী পর্যবেক্ষণের পর তার বর্ণনায় অষ্টমীরচর কে ভরুণীর চর এবং অষ্টমীর স্নান ও মেলা কে বার্ণির স্নান ও বার্ণির মেলা উল্লেখ করে লিখেন-
At a Varunichar, on the Brohmoputro above chilmari, Hindu pilgrims assemble in great multitudes on the festival of Varuni and there is a great fair. In ordinary years about 60000 are said to meet : but the number incrince to 100000 when the fastivalheppensan a wednesday. On the such occasions people com even from Benares (varanosi) and Jogonnath. On the pagla river an assembly (Mela) takes place every sunday in the month chaitro of spring. Both Moslem and Hindus frequnt This meeting: the former call the place paglapir the latter call it pagla Dev: on each occusion about 1000 persons from the vicinity assemble bathe and held a fair. The village gods are the same as in the following division. There are no remains of ancient times that are at all remarkable.) (“Montgomery Martin ” Eastern Indin Voll-lll, London,)
যার অর্থ দাঁড়ায় “ চিলমারী বন্দর আর ব্রহ্মপুত্রের মাঝে বার্নির চরে (বর্তমান অষ্টমীরচরে) হিন্দুদের বার্নি উৎসবে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলে স্নান করতে প্রতিবৎসর প্রায় ৬০,০০০ তীর্থযাত্রী স্থানীয় এবং অন্যান্য অঞ্চল হতে এসে সমবেত হতো এবং এ উপলক্ষ্যে বিরাট বার্ণি বা বান্নি মেলা বসতো । তবে এই তীর্থ যাত্রীর সংখ্যা প্রায় ১,০০,০০০ ছাড়িয়ে যেত, যদি এ তীর্থের দিন কোন বছর বুধবারে নির্ধারিত হতো, এ সময়ে তীর্থযাত্রীরা বেনারস এবং জগন্নাত হতেও আসতো বলে উল্লেখ আছে।
মার্টিনের এই লেখা থেকে এটা নিশ্চিত হওয়া গেছে চিলমারীর অষ্টমীর স্নানের ইতিহাস হাজার বছরের ঐতিহ্য বহন করছে। তবে ১৮৩৮ ইং সালে যে অষ্টমীর স্নান হত চিলমারীতে, সেই অষ্টমীর স্নান এবং মেলা ইংরেজী ২০২০ ইং সালে এসে হারাতে বসেছে তার ঐতিহ্য, তার প্রকৃত আস্বাদন । সময়ের বিবর্তনে বদলে যাচ্ছে মানুষ, মানুষের আচরণ এবং তাদের সংস্কৃতির ধারা । পূর্বে যেমন এ অঞ্চলে যানবাহন বলতে ছিল একমাত্র গরুর গাড়ি। বর্তমানে গরুর গাড়ির জায়গা দখল করেছে ব্যাটারি চালিত রিক্সা, অটোরিক্সা, সিএনজি, মটরবাইক, বাস, টেম্পু, ট্রেনসহ আরো অনেক ধরনের যানবাহন । চিলমারী উপজেলায় এই অষ্টমীর স্নান কেন হয় ? সনাতন ধর্মের কোন যোগসূত্র ইতিহাসে কি আছে চিলমারী কে ঘিরে? পূর্বে অষ্টমীর স্নান ও মেলার চেহারা বা ধরণটা কেমন ছিল ? বর্তমানে অষ্টমীর স্নান ও মেলার আকার বা ধরণ আগের মতই আছে নাকি পরিবর্তিত হয়েছে? এসব নিয়ে আলোচনায় যাওয়ার পূর্বে অপ্রাসঙ্গিক হলেও একটি গান নিয়ে কিছু কথা শুরুতেই লিখতে চাই।
সংগীত শিল্পী সতিশ চন্দ্রের কথা । ভাওয়াইয়া গানের চারণভূমি বৃহত্তর রংপুর জেলা । রংপুর জেলার কাউনিয়া উপজেলার বাসিন্দা শিল্পী সতিশ চন্দ্র । সংগীত চর্চা তার নেশা । পেশায় তখন কুড়িগ্রামের চিলমারীতে অবস্থিত ছিন্নমুকুল নামক একটি এনজিওতে সঙ্গীত শিক্ষক পাদে চাকুরি করতেন । সতিশ আমার কারমাইকেল কলেজ জীবনের একজন অত্যন্ত কাছের বন্ধু। আচার-আচরণে স্বভাব কবি বললেও তার সম্পর্কে বলায় কমতি থেকে যায় । শিল্পী সতিশকে তখন চিলমারী ও কুড়িগ্রামের সঙ্গীতাঙ্গনের সাধক অনুরাগীরা এক নামেই চিনতো । কারণ নানা গুণের ও প্রতিভার অধিকারী ছিল সতিশ । ১৯৯৫ইং সালে অষ্টমীর স্নান করতে গিয়েছিল শিল্পী নিজেই । চিলমারীর অষ্টমীর স্নান ও মেলার তখনকার অবস্থা দেখে ভগ্ন হৃদয়ে ফিরেছিল সে। তারপর মনের মন্দিরে কথার মালায় বাঁধলেন একটি গান । সুর করলেন শিল্পী নিজেই । সময়ের বির্বতনের কথা, এই এলাকার সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের কথা তুলে ধরলেন তিনি তার গানটিতে। গানটির কিছু অংশ নিম্নে তুলে ধরলাম-
*আগের দিন আর নাইরে রতন
দিন হইয়াছে আরেক মতন
দিনে দিনে দিন গেইছে বদলিয়া
ওরে, নাই সে আগের গরুর গাড়ি
নাই সে আগের চিলমারী
নাইওরী আর না যায় ছই ঘিরিয়া।*
এ এলাকার নদী ভাঙ্গা মানুষের হৃদয়ে গানটি চিরকালের মতো স্থান করে নিল । সতিশ চন্দ্র বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভূক্ত কোন শিল্পী, সুরকার অথবা গীতিকার ছিলেন না, যার কারণে ঐ গানটি পরবর্তীতে বেতারের স্থায়ী কোন একজন গীতিকারের নাম দিয়ে রংপুর বেতার থেকে একাধিক বার প্রচারিত হয়েছে। রংপুর বেতার কেন্দ্রের ভাওয়াইয়া শিল্পী শ্রী ভবতরণ বর্মণ শিল্পীর নিজ কন্ঠ থেকে (সতিশের) গানটির সুর ও কথা তার কণ্ঠে ধারণ করে বিভিন্ন মঞ্চে গানটি গেয়ে তিনি নিজেও এলাকার মানুষের মনের মনিকোঠায় স্থান করে নিয়েছেন । সতিশের গানের বিষয়টি একেবারে অপ্রাসঙ্গিক নয় । চিলমারীর অষ্টমীর স্নান ও মেলার অতীত ও বর্তমান চিত্র তুলে ধরলে শিল্পীর গাওয়া গানটির মর্মবেদনা স্পষ্ট হয়ে উঠবে । শিল্পী তার গানে যথার্থই লিখেছেন -নাই সে আগের চিলমারী । ব্রহ্মপুত্র নদের বিরামহীন ভাঙ্গনের সাথে পাঞ্জা লড়তে লড়তে এলাকার মানুষ আজ ক্লান্ত। নদের ভাঙ্গনে ভিটে-মাটি, জমি-জমা হারিয়ে হাজার হাজার মানুষ আজ সর্বহারার মিছিলে যোগ দিয়েছে। তবুও চিলমারীর মানুষ হারতে নারাজ। আজও তারা নানা প্রতিকুলতার সাথে সংগ্রাম করে টিকে আছে । এ এলাকার সংগ্রামী জনতা নদী ভাঙ্গন, বন্যা, ক্ষুধা আর দারিদ্রের নির্মম কষাঘাতে জর্জরিত হয়েও হারিয়ে যেতে দেয়নি তাদের পুরাতন ঐতিহ্য । আজও প্রতিবছর বাংলার চৈত্র মাসে চিলমারীতে হাজার হাজার মানুষ আসে ব্রহ্মপুত্রের জলে অষ্টমীর স্নান করতে । আগে ব্রহ্মপুত্র স্নানের তিন দিন পূর্ব থেকেই চিলমারীতে সাজসাজ রব পড়ে যেত। দুর-দুরান্ত থেকে খুদে ব্যবসায়ীরা চলে আসতো চিলমারীতে । ব্রহ্মপুত্র নদের বালুচরে পেতে বসতো খোলা দোকান। বাঁশ আর টিনের সমন্বয়ে তৈরী করা হতো অস্থায়ী মিষ্টি ও জিলাপির দোকান। বালুর চরের উপর তৈরী করা হতো, নানা ধরনের পণ্য বিক্রির ষ্টল । বড় বড় রুই, কাতলসহ নানা জাতের মাছ বিক্রির লম্বা লাইন করে বসতো মাছের গলি। আসতো বাইসকোপ, সার্কাস, যাদুরখেলা দেখানোর দল। মেলায় বসতো নানা ধরনের খেলনার দোকান । বাঁশের বাঁশিওয়ালা, চুড়ি ও আংটি বিক্রির ফেরিওয়ালারাও আসতো মেলায়। ৪ থেকে ৫মাইল দীর্ঘ নদীর উপকুল ধরে বসতো হরেক রকমের দোকানপাট । তবে এই মেলায় সে আদি যুগ থেকে প্রাধান্য পেয়েছে মৃৎ শিল্প । মাটির তৈরী হাড়ি, থালা, বদনা থেকে নিত্য প্রয়োজনীয় পারিবারিক জিনিস-পত্র উঠতোই, এসবের পাশাপাশি উঠতো বিভিন্ন দেব-দেবীর মূর্তি, পুতুল, বাঘ, আম, নৌকা ইত্যাদী, এগুলোও ছিল মাটির তৈরী ।
এ মেলায় মৃৎ শিল্প প্রাধান্য পেয়েছে দুটি কারণে । প্রথমতঃ প্রাচীন কাল থেকেই পূণ্যার্থীরা মাটির তৈরী বাসন-কোসন ব্যবহার করতো । দ্বিতীয়তঃ দুরদুরান্ত থেকে যারা আসতেন তারা হাড়ি পাতিল সঙ্গে আনতেন না। এ সব কারণে আগত পুণ্যার্থীরা, যে দুই তিন দিন ধর্মীয় কারণে চিলমারীতে অবস্থান করতেন, তারা অল্প টাকায় মাটির বাসন- কোসন কিনে তাদের প্রয়োজন মিটানোর পর ওগুলো নদের বালু চরে ভেঙ্গে ফেলে রেখে চলে যেতেন । তখন থেকে অদ্যাবধি সে প্রথাই চলে আসছে ।
মৃৎশিল্পের পাশাপাশি আর যে সকল দ্রব্যাদি এই মেলার ঐতিহ্যবাহী পণ্য হিসেবে আজও পরিচিতি ধরে আছে তাহলো, তালের পাখা (বিভিন্ন ডিজাইনের নানা রঙের তালের পাখা ) এছাড়াও পাওয়া যেত তালপাতার সিপাই, চাক্খুটি (চার পাঁচটি মাটির খুটি সমন্বীত বাসন), শোলার তৈরি কুমির, হাতি, ফুল, ঝাড়বাতি ইত্যাদি ।
১৯৪৫ সালে মনতলা -নামক স্থানে নদীর উপকূল ঘেঁষে এই মেলাটি হত। তখন চিলমারী উপজেলাটি প্রাচীন নৌ বন্দর হিসেবে পরিচিত ছিল। ১৯৪৫ সালে অর্থাৎ অবিভক্ত বাংলায় এ অঞ্চল থেকে পাট ও পাটজাত দ্রব্যাদি জাহাজ অথবা নৌকা যোগে চিলমারী বন্দর থেকে দু’টি স্থানে আনা-নেয়া করা হতো। একটি স্থান ছিল আসামের জলপাইগুড়ি জেলার ধুবড়ি নৌ বন্দরে এবং অপর স্থানটি ছিল ঢাকার নারায়নগঞ্জ বাণিজ্যিক নৌ-বন্দরে। তখন চিলমারী থেকে ধুবড়ি পর্যন্ত জাহাজ ভাড়া ছিল মাত্র ১৪ আনা। সে সময় চিলমারীর অষ্টমীর মেলাতে স্নান করার জন্য যারা আসতেন তাদের বিরাট অংশটি আসতো আসামের বিভিন্ন এলাকা থেকে। ঐ এলাকা থেকে পুণ্যার্থী তো আসতোই, তাছাড়াও আসতো প্রচুর জটাধারী সাধু –- সন্ন্যাসীরা। এছাড়াও তদানীন্তন পূর্ব বাংলার রংপুর, দিনাজপুর, ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা থেকে পুণ্যার্থীরা জীপ, মোটরগাড়ি যোগে আসতো চিলমারীতে। তবে দূর -দূরান্তের অধিকাংশ পুণ্যার্থীরা আসতো ট্রেনে করে। কয়লার ইঞ্জিনের ট্রেন মহুকুমা শহর কুড়িগ্রাম পর্যন্ত আসতো। এই ষ্টেশনটিই শেষ ষ্টেশন ছিল। কুড়িগ্রামে ট্রেন থেকে নামার পর গরুর গাড়িতে চেপে চিলমারীতে আসতে হত। আর সে কারণে গরুর গাড়ির বিরাট বহর (৩ থেকে ৪ মাইল দীর্ঘ লাইর্ন ) দেখা যেত মাটির রাস্তায়।ধুলা রাস্তায় কুড়িগ্রাম থেকে চিলমারী আসতে আসতে পূণ্যার্থীদের চেহারাই পাল্টে যেতো। অষ্টমীর মেলার কোন এক পার্শ্বে ৫/৬ একর জমির মধ্যে এ সকল গরুর গাড়ি পার্কিং এর ব্যবস্থা করা হতো। মনতলা জায়গাটি বর্তমানে যে জায়গায় রমনা রেল ষ্টেশন, সেখান থেকে অনেক দুরে ছিল। সেই স্থানটি এখন নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে । প্রবীণ ব্যক্তিদের নিকট থেকে জানাযায়, ভোরে ( অর্থাৎ রাত ৩টা) পায়ে হেটে পুরাতন চিলমারী নৌ বন্দর থেকে রওনা দিলে অষ্টমীর মেলায় পৌঁছাতে পান্তার বেলা ( অর্থাৎ দুপুর ১২টা ) বেজে যেত। অষ্টমী স্নান নাম করণ কেন হল আর কেনই বা এই স্নান চিলমারীতে হয়? -এখন সে দিকটি নিয়ে আলোচনা করব। প্রতি বছর চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষের অষ্টম তিথিতে এই স্নান হয় বলে এই স্নানের নামকরণ অষ্টমীর স্নান।(চলবে)
(বিঃদ্রঃ লেখাটি লেখকের * হামার চিলমারী * বই থেকে নেয়া। এই লেখাটি হুবহু কেউ নিজের নাম দিয়ে অনলাইন বা প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কারণ * হামার চিলমারী* বইটির আইএসবিএন নাম্বার রয়েছে। তবে যে কোন লেখক বইটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে লিখতে পারবেন।)