ফারুক আহমেদ
ঈদ শব্দটি আরবী। ‘আউদ’ ধাতু থেকে এসেছে। এর অর্থ হল পুনরাগমন যা বারবার ফিরে আসে। বৎসরান্তে নির্দিষ্ট সময়ে বারংবার ফিরে আসে বলেই এই মিলন ও সম্প্রীতির উৎসবের নাম হয়েছে ঈদ। ঈদ সকলের মনে আনে খুশি। তাই খুশির উৎসব হল ঈদ। খুশির জন্য চাই সকলের খোলামেলা মন। মুক্ত মনের বহিঃপ্রকাশেই ঈদ মিলন উৎসব সার্থক হয়। তাই ঈদের আনন্দ খুশি ছড়িয়ে পড়ে সংকীর্ণ ভেদ-বুদ্ধির সীমানা আলগা করে জাতি ধর্ম-বর্ণ ও ভাষার গণ্ডি পেরিয়ে সকল সম্প্রদায়ের কাছে চিরন্তন সৌহার্দ্য, সম্প্রীতি, শাশ্বত প্রেম ও মহা মিলনের খুশির বার্তা নিয়ে।
‘ফিতর’ অর্থে খুলে খুলে যাওয়া মুক্ত হওয়া বা পূর্ণতা প্রাপ্ত যা সমাপ্ত হওয়া বুঝায়। কেউ কেউ ফিতর অর্থে শেষের পর্বে খাওয়ার অর্থ বুঝে থাকেন। তাই ঈদ-উল-ফিতর সেই বিশেষ দিনটির নাম, যেদিন দীর্ঘ এক মাস রমজানের নিয়মানুগ কঠোর উপবাস, এবাদত ও সবরকম অপরাধ থেকে দূরে থাকার বিধিনিষেধ, অনুশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণের সাধানায় নিযুক্ত থেকে পুনরায় দৈনন্দিন আহারের নিযুক্ত হওয়ার অনুমতি। আসলে ঈদ-উল-ফিতর হল আল্লাহ’র কাছ থেকে পাপমোচন করে নিজেকে সৎ পথে ফিরিয়ে আনা। তাই মহা আনন্দে পালিত হয় এই খুশির উৎসব ঈদ-উল-ফিতর। নবী করিম (সঃ) বলেছেন—“নিশ্চয়ই প্রত্যেক জাতির ‘ঈদ’ অর্থে আনন্দোৎসব আছে। তাই আজকের দিন অর্থৎ ঈদ-উল-ফিতর হল আমাদের সকলেরই সেই খুশির ঈদ।” ঈদ সারা বিশ্বে সকল মানুষের জন্য প্রসন্নতার সুখবর এনে দেয়। ঈদের দিন সকল সামর্থ্যবান মুসলিমকেই মুক্ত হাতে ফেতরা, জাকাত, সাদকা ও দান খয়রাত করতে হয়। যার ফলে, আমাদের সমাজের প্রতিটি আর্ত পীড়িত অসহায়, বিপন্ন সর্বহারা ও হতদরিদ্র মানুষেরাও এই খুশির ভাগ নিতে পারেন। এখানেই এই মিলন উৎসবের সার্থকনামা সকলের মধ্যেই সঞ্চারিত হয়। ঈদ হল ত্যাগের, ধৈর্যের, ক্ষমার, ভালবাসার, সাম্য, মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ববোধের প্রতীক। সকলের মনে ন্যায় ও নীতিই সঞ্চারিত করার পক্ষে আদর্শ।
সকল মুসলিম রমজান মাসে রোজা রেখে ক্ষুধা ও তৃষ্ণাকে ভুলে গিয়ে কঠোর সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে নিজের দোষ ত্রুটি সংযোধন করে আত্মশুদ্ধি করতে বদ্ধপরিকর হয়ে আল্লাহ’র নৈকট্য লাভ করতে পারেন। নবী করিম (সঃ) বলেছেন- ‘যে রোজা আমাদের আত্মশুদ্ধি করে না, সেই রোজা প্রকৃত রোজা নয়, তা নিছক উপবাস মাত্র যা গন্ধহীন ফুল কিংবা নিষ্প্রাণ দেহ মাত্র।’ তাই খাদ্য ও পানীয় থেকে দূরে থাকার নাম রোজা নয়। প্রকৃত রোজা হল অন্যায় ও অসৎ চিন্তা থেকে বিরত থাকা।
‘রমজান’ শব্দের অর্থ হল অগ্নিদগ্ধ। যে মাসে রোজা পালনের মধ্য দিয়ে অনাহারের তীব্র দহনজ্বালা ও সহনশীলতার কঠিন পরীক্ষা, সেই মাসের গুণাগত নাম হল রমজান। রোজার উপবাস দ্বারা প্রশমিত হয় রোজদারের অসৎ চিন্তা ও কুমনোবৃত্তি। সীয়াম সাধনায় মানুষরের মনে বেড়ে যায় তাঁর আত্মিক, মানসিক ও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি। তাই মাহে রমজানে মুসলিমদের মনে ও সমাজে নেমে আসে, দয়া-মায়া, স্নেহ-প্রীতি, ভক্তি-করুণা ও সহনশীলতার মতো অজস্র সৎ চিন্তার বিচিত্র সমারোহ।
মুসলিম জাহানে রমজান মাস হল রহমতের মাস, বরকতের মাস, গোনাহ পাপ মাফ হওয়ার মাস, আল্লাহ’র অসীম করুণায় নৈকট্যলাভের মাস, আত্মশুদ্ধির মাস, ধৈর্যের মাস, সাধনার মাস ও সকল দুস্থ গরিব, অনাথ ও দীন-দুঃখীর সাহায্য করার মাস। প্রকৃত সমাজ বিকাশে ও শিক্ষা প্রসারের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়ারও মাস। তাই শাশ্বত কালের চিরন্তন সাম্য, মৈত্রী ও বিশ্বভ্রাতৃত্ব প্রীতির বন্ধন ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতর জাতীয় সংহতির জ্বলন্ত প্রতিক হল মহামিলনের মহোৎসব ঈদ-উল-ফিতর। ঈদ পালনে জাতিধর্ম নির্বিশেষে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে মধুর আলিঙ্গণের মধ্যে খুঁজে পাই—বৈচিত্রের মধ্যে একতার মধুর ও অনাবিল ঐকতানের আনন্দ খুশির অত্যুজ্বল সুবর্ণময় তিথি। ঈদ বয়ে আনুক বিশ্বের সকল মানুষের জন্য অফুরন্ত শান্তি সুখ ও সমৃদ্ধি এবং গভীর ভালবাসা। তাই আসুন, আমরা সকল সম্প্রদায়ের মধ্যে বিভেদকে দূরে ঠেলে ঈদ মিলনের মধ্য দিয়ে সম্পীতির বন্ধনে ও আলিঙ্গণে আবদ্ধ হয়ে প্রকৃত মানুষ রূপে নিজেদেরকে গড়ে তুলি। আর তা করতে পারলেই দেশ ও দশের সত্যি মঙ্গল হবেই। সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনা ও মানুষের ক্ষতিসাধন থেকে সাধারণ মানুষদের বুঝিয়ে সৎ পথে আনতে পারলেই সমাজ উপকৃত হবে। তখনই মহতি ঈদ পালনের উদ্দেশ্য সফল হবে বলে মনে করি। তাই এই সমাজকে শিক্ষা সচেতন করে তোলা জরুরি। ঈদ মিলনের ময়দানে জায়নামাজে দু’হাত তুলে শেষ দোয়ায় শপথ নিতে হবে আমাদেরকে সকলের জন্য সুস্থ সমাজ গড়ার। মনের মধ্যে রাগ-অভিমানকে কমিয়ে নিজেদের অধিকার নিজেদেরই অর্জন করতে হবে। কারণ কারও মৌলিক অধিকার কেউ পাইয়ে দিতে পারে না, তা নিজ যোগ্যতায় ছিনিয়ে নিতে হয়। নিজেদের মধ্যে হানাহানি ও কাটাকাটি না করে, কে কী দিল আর দিল না, এই ভেবে সময় নষ্ট করার থেকে যার যেটুকু ক্ষমতা আছে তাই দিয়ে নিজের অনগ্রসর সম্প্রদায়কে টেনে তুলতে হবে। পাড়ায়-পাড়ায় শিক্ষা থেকে বঞ্চিত প্রতিভাদেরকে শিক্ষা আলোয় আলোকিত করতে হবে নিজেদেরই। তাহলে সমাজ ও দেশ এগিয়ে যাবে সামনে আরও সামনে। ভ্রান্ত ধারণাগুলোকে ভুল প্রমাণ করে নিজেদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। মুসলিম বলে কিছু হবে না। এমন ধারণা পোষণ করা পাপ। ইসলাম সৎ পথে সঠিক লক্ষ্যে সামনে এগিয়ে যাওয়ার সাহস জোগায়। পারতেই হবে। আধুনিক শিক্ষা প্রসারে বাংলার অনন্য পথিকৃৎ মোস্তাক হোসেন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালের দেশভাগের পর পশ্চিমবঙ্গের মুসলিমদের অবস্থা ছিল একেবারেই করুণ ও সংকটাপন্ন। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য কালের ধারাবাহিকতায় নানা পর্যায়ের কায়িক শ্রম ও ছোট পরিসরে ব্যবসা করে কেউ কেউ স্বল্পবিস্তর আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে শুরু করে। তবে কেউ কেউ আর্থিকভাবে সচ্ছল হতে শুরু করলেও শিক্ষাদীক্ষায় তাদের অবস্থান ছিল একেবারে তলানিতে। সেই অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটতে শুরু করে আশির দশকে। আর এই পরিবর্তনের নিমিত্তে মহীরুহ হিসেবে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছেন বিশিষ্ট সমাজসেবক ও শিল্পপতি মোস্তাক হোসেন। মহৎপ্রাণ এই মানুষটি উদার হস্তে ব্যক্তিগত তহবিল থেকে অর্থ দিয়ে আধুনিক শিক্ষার প্রসারে মানবতার দূত হিসেবে এগিয়ে আসেন। দৃঢ় প্রত্যয়ে তাই বলতে হয় পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে মোস্তাক হোসেন-এর আর্থিক সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠা পাওয়া মিশন স্কুলগুলো। তাঁর একক কৃতিত্ব ও সোনালি পৃষ্ঠপোষকতার কারণে বাঙালি মুসলিম সমাজ অন্ধকার জগৎ থেকে আলোর পথে প্রবেশ করেছে। এমনকী তাঁর প্রত্যক্ষ পৃষ্ঠপোষকতার কারণে জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সবশ্রেণির মানুষ প্রতিনিয়ত উপকৃত হচ্ছেন। সে কারণে আজ বলতে হয়, পশ্চিমবঙ্গের অনগ্রসর মুসলিম মানসে আধুনিক শিক্ষাবিস্তারে বসন্ত এনে দিয়েছেন দানবীর মোস্তাক হোসেন। সমাজসেবী ও দানবীর মোস্তাক হোসেনকে তাই অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম গড়ে উঠবে মানবকল্যাণের অগ্রযাত্রায়। সংগত কারণে কৃতজ্ঞতার দায়বোধ থেকে নয়া সমাজ নির্মাণের অগ্রনায়ক মোস্তাক হোসেনকে কুর্নিশ জানাই।
জি ডি স্টাডি সার্কেলের মিশন স্কুল গড়ে উঠেছে মোস্তাক হোসেন-এর আর্থিক সহযোগিতা নিয়ে। এই মিশন আন্দোলনে শিল্পপতি মোস্তাক হোসেনের সোনালি পৃষ্ঠপোষকতার ফলেই বাঙালি মুসলিম সমাজ এগিয়ে আসছে। তাঁর ছত্রছায়ায় জাতি-ধর্ম-বর্ণ-গোত্র নির্বিশেষে সকলেই উপকৃত হয়েছেন এবং নিয়মিত হচ্ছেন। বর্তমানে মুসলিম দরদী সহমর্মী মোস্তাক হোসেনকে অনুসরণ করে নতুন প্রজন্ম উঠে আসুক সমাজকল্যাণে। অনুপ্রেরণা অবশ্যই মোস্তাক হোসেন। মামূন ন্যাশানাল স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা হলেন বক্তা সম্রাট গোলাম আহমদ মোর্তজা। জি ডি স্টাডি সার্কেলের পরিচালনা সমস্ত মিশন স্কুলগুলোর মধ্যে অন্যতম মিশন স্কুল হচ্ছে মামূন ন্যাশানাল স্কুল। ইতিমধ্যে জি ডি স্টাডি সার্কেলের উদ্যোগে সরকারি চাকরির উপযুক্ত করে তুলতে কোচিং দিয়ে বড় সাফল্য লাভ করেছে। রাজ্যের বিভিন্ন সরকারি দফতরে নতুন প্রজন্ম যোগ্যতা প্রমাণ করে চাকরি পাচ্ছেন। মোস্তাক হোসেন ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করছেন বলেই বাংলার ঘরে ঘরে প্রতিষ্ঠিত হচ্ছেন পিছিয়ে পড়া সমাজের একটা অংশ।
লেখক: সমাজকর্মী, প্রকাশক ও সম্পাদক: উদার আকাশ।