২৯ মার্চ ২০২৩ ইং চিলমারীতে অনুষ্ঠিতব্য অষ্টমীর স্নান উপলক্ষে লেখক নাজমুল হুদা পারভেজের লেখা
* হামার চিলমারী*-বই থেকে উদ্ধৃত
পর্ব-দুই
লেখকঃ নাজমুল হুদা পারভেজ
যে কারণে চিলমারী ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমীর স্নান হয়
ইতিহাস ঘেঁটে জানাযায়, কোন এক দূর অতীতে জমদগ্নি মহামুনির রেনুকা নামে এক রাজ বংশীয় পরমা সুন্দরী স্ত্রী ছিল। তাদের ছিল পাঁচ পুত্র। সর্ব কনিষ্ঠের নাম ছিল পরশু রাম। ঘটনাক্রমে মার্তিকাবর্ত দেশের রাজাকে সস্ত্রীক জল বিহার করতে দেখে আশ্রম বাসিনী রেণুকা কাম স্পৃহ হয়ে পড়েন এবং নিজের পূর্ব-রাজকীয় জীবন সম্পর্কে স্মৃতিবিষ্ট হন। মুনি স্ত্রীর এই আসক্তি দেখে ক্রোধান্বিত হয়ে পাঁচ পুত্রকে তাদের মাতাকে হত্যার নির্দেশ দিলেন। কিন্ত কোন পুত্রই মাতৃ হত্যার মতো নিষ্ঠুর কাজ করতে রাজি হলোনা। তখন মুনি তার প্রিয় পুত্র পরশু রামকে ডেকে বললেন, পুত্র,আমি কি তোমার পিতা? প্রশ্ন শুনে পরশু রাম অবাক হলেন এবং বললেন “হ্যা, অবশ্যই তুমি আমার পিতা। তখন জমদগ্নি ঋষি পুত্রের নিকট এসে অত্যন্ত আদুরে কণ্ঠে বললেন “ আমি যদি তোমাকে কোন কঠোর নির্দেশ দেই ,তাকি তুমি পালন করবে ”? পুর্বের মতো এবারেও পরশু রাম বলল, অবশ্যই। কেন করব না ? পুত্রের সম্মতি পেয়ে এবার জমদগ্নি ঋষি পুত্রকে নির্দেশ দিলেন “যাও, এই মুহূর্তে কুঠার দিয়ে তোমার মাতা ও চার ভ্রাতাকে হত্যা করো ”। পিতার এমন অমানবিক নির্দেশ শুনে পরশু রাম কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পরে। জমদগ্নি ঋষি পুত্রকে ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে পুনরায় নির্দেশ দেন- “যাও পিত্রাদেশ পালন করো। নচেৎ তুমি, আমার কঠিন অভিশাপে অভিশপ্ত হবে”।
উপায়ান্ত খুঁজে না পেয়ে অবশেষে পরশুরাম কুঠারের আঘাতে নির্মম ভাবে তার মা ও ভ্রাতাদের কে হত্যা করে। কিন্ত একি, কুঠার তো আর হাত থেকে খুলছেনা। পরশু রাম তখন তার হাতে আটকে থাকা রক্তাক্ত কুঠার সমেত পিতৃ চরণে লুটায়ে কাঁদতে লাগলেন। কাঁদতে কাঁদতে তিনি বললেন “ পিতা, আমি তো পিত্রাদেশ পালন করেছি। এবার তুমি তোমার মহত্তের গুণে আমার মা ও চার ভ্রাতাকে জীবিত করে দাও। পুত্রের কান্না দেখে পিতার মন অবশেষে শীতল হলো। ঋষি পরশু রামের মৃত মাতা ও চার ভ্রাতার জীবন দান করলেন। একটি সমস্যার সমাধান তো হল বটে কিন্ত পরশু রামের হাত থেকে কুঠার তো আর খুলছে না। আবার পরশু রাম পিতার চরণে মাথা রাখলেন। বললেন “ পিতা আমার হাত থেকে কুঠার খুলছেনা কেন? জবাবে ঋষি বললেন-
ঃতুমি মাতৃহত্যা করার পাপে অভিশপ্ত। পাপমোচন না হওয়া পর্যন্ত কুঠার তোমার হাত থেকে খুলবেনা বৎস।
ঃ পিতা, আমি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পাবো কি ভাবে ?-তুমি বলে দাও।- জানতে চায় পরশু রাম । অবশেষে জমদগ্নি ঋষি বললেন-
ঃ তুমি যদি এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে চাও,তাহলে তোমাকে ওই কুঠার হাতে আটকানো অবস্থায় সমস্ত পীঠস্থান ভ্রমণ করতে হবে। পীঠাস্থান ভ্রমণ শেষে তোমাকে যেতে হবে, কোশলের বষ্ণুদশা নামে পরিচিত দ্বিজের নিকট। তিনিই তোমার এই অভিশাপ মোচনের পথ দেখাবেন। কি আর করা? অবশেষে পরশু রাম পিতার পরামর্শ মতো অভিশপ্ত কুঠারটি হাতে নিয়েই পীঠস্থান ঘুরতে বের হলেন। গোটা ভারত বর্ষে যতগুলো পীঠস্থান আছে সর্বত্র এভাবেই ঘুরতে ঘুরতে এক সময় এসে পৌঁছলেন কোশলের দ্বিজ বিষ্ণুদশার নিকট। বিষ্ণুদশা পরশু রামের অভিশপ্ত হবার সমস্ত কাহিনী মনোযোগ দিয়ে শুনলেন এবং বললেন-
ঃ মানস সরোবরে যাও। দেবতা ব্রহ্মপুত্র হিমালয়ের বুকে হ্রদ রূপে লুকিয়ে আছে। পরশু রাম বিষ্ণু দশার নিকট থেকে ব্রহ্মপুত্রের মাহাত্ম্যের কথা জানতে পেরে ছুটে গেলেন মানস সরোবরে। তিনি খুঁজে পেলেন হিমালয়ে লুকায়িত ব্রহ্মপুত্র হ্রদ এবং প্রার্থনা জানালেন যেন এর পবিত্র জলে তার পাপ মুক্ত হয়। তিনি হ্রদের জলে ঝাঁপ দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হাতে আটকে থাকা কুঠার খানা হাত থেকে খুলে গেল। এভাবে তিনি মাতৃহত্যার প্রায়শ্চিত্ত থেকে মুক্ত হলেন। ব্রহ্মপুত্রের এই অলৌকিক শক্তি সম্পন্ন পাপ হরণকারী জল যাতে সাধারণ মানুষের উপকারে আসে সে উদ্দেশ্যে পরশু রাম সেই জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসার অভিপ্রায় প্রকাশ করেন। তিনি কুঠার খানা লাঙলের ফলকে বেঁধে সেই ফলক দিয়ে নালা সৃষ্টি করে ব্রহ্মপুত্রের পবিত্র জলধারাকে সমতল ভূমিতে নিয়ে আসেন। মাতৃ হত্যার অভিশাপ থেকে মুক্তির দিনটি ছিল চৈত্র মাসের শুক্লা পক্ষের অষ্টম তিথি। (মহাভারত, পৃষ্ঠা-১০০৩ লেখক শ্রী কাশিরাম দাস)।
তখন থেকেই সনাতন ধর্মাবলম্বীরা জীবনের সকল পাপ মোচনের জন্য প্রতিবছর নির্দিষ্ট এই দিনটিতে স্নানের জন্য ছুটে আসেন কুড়িগ্রামের চিলমারী বন্দরের ব্রহ্মপুত্র নদে। হিন্দু ধর্ম বিশেষজ্ঞগণ , মহাভারত, কলিকা পুরান, হিন্দুশাস্ত্র চৈতান্য চরিতামৃত বিভিন্ন শাস্ত্রে কাহিনী বর্ণনায় কিছুটা অমিল থাকলে ও মুল বিষয় বস্ত একই। তবে তীর্থের প্রকৃত স্থানটির ব্যাপারে দ্বিমত রয়েছে। অনেকের মতে, পরশুরাম কুড়িগ্রাম হয়ে পূর্ব বাংলা অথাৎ বর্তমান বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। তিনি চিলমারী নামক এলাকায় প্রথম বিশ্রাম নেন এবং পরে দক্ষিণে এগিয়ে যান। সে কারণেই প্রাচীন যুগ থেকে চিলমারীর ব্রহ্মপুত্র নদে অষ্টমীর স্নান হয়ে আসছে।
(বিঃদ্রঃ লেখাটি লেখকের * হামার চিলমারী * বই থেকে নেয়া। এই লেখাটি হুবহু কেউ নিজের নাম দিয়ে অনলাইন বা প্রিন্ট মিডিয়াতে প্রকাশ করলে তার বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। কারণ * হামার চিলমারী* বইটির আইএসবিএন নাম্বার রয়েছে। তবে যে কোন লেখক বইটিকে তথ্যসূত্র হিসেবে উল্লেখ করে লিখতে পারবেন।)