(আন্তর্জাতিক নারী দিবসের চিন্তা)
— নুরে আলম মুকতা
আমার সমস্ত জীবন জুড়েই আম্মা। সমস্ত কর্ম উদ্দীপনা আর উৎসাহ আম্মা। আমি যখন কোন কাজ করতে গিয়ে বিব্রত হই,মারাত্মক জটিলতায় পড়ে যাই তখন আমি বুঝতে পারি অদৃশ্য চারটি হাত আমাকে বেষ্টন করে আছে। ওরা যেন আমাকে বলছে, কি হয়েছে বাবা, কোন সমস্যা হয়েছে তোমার? এরকম পরিস্থিতিতে আমি বিস্মিত হই কিন্তু কখনও ভেঙ্গে পড়িনা। বাবারা পৃথিবীর সেরা শক্তি। কিন্তু মা! সুবহানাল্লাহি অবি হামদিহি!
মায়েরা আরো বেশি ক্ষমতাধর। উৎসাহ,উদ্দীপনা, শিক্ষক, পরিচালক আরো কত যে বিশেষণে বিশেষায়িত করা যায় বলা মুশকিল।
আমি আম্মাকে ছোট ছোট অজস্র প্রশ্ন করতাম। কোনদিন বিব্রত হতে দেখিনি। বিরক্তির কোন চিহ্ন ছিলো কিনা তা আমি আজো খুঁজে ফিরি। সেক্স,দর্শন,মনোবিজ্ঞান,পুরনো ইতিহাস,নৃবিজ্ঞান সংশ্লিষ্ট প্রশ্নগুলো অবলিলায় সহজ উত্তর দিতেন। এখন আমি ভাবি আম্মা কেমন করে এগুলো সম্পর্কে জেনেছিলেন। আব্বার প্রেমিকা স্ত্রী বলে কি এত সুশিক্ষিত আর সংস্কৃতিমনা হয়ে উঠতে পেরেছিলেন!
একদিন আব্বার দেয়া বাড়ির পড়া প্রস্তুত করতে বসেছি। কিন্তু জট খুলতে পারছি না। ন্যারেশন করছিলাম। রিপোর্টেড স্পিচটি এক্সক্ল্যামাটরি সেনটেন্স ছিলো। আমি অস্বস্তিতে পড়ে গিয়েছি আম্মা রাঁধতে রাঁধতে দেখতে পেয়েছিলেন। মোহনীয় পায়ে ধীরে হেঁটে এসে আমার কাঁধে কোমল, মায়াময় হাত রেখে বললেন, কি হয়েছে বাবা। আব্বার দেয়া পড়া রেডি করতে পারছি না, দুরু দুরু বুকে আম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম। আম্মা আমার খাতাটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ দেখে বললেন, এভাবে করো হয়ে যাবে।
আমাদের পড়ার নির্দিষ্ট সময় ছিলোনা। বেশ কিছুক্ষণ পর আব্বা বাড়ি ফিরে আমাকে খাতা কলম নিয়ে ডাকলেন। আমার খাতা দেখে বললেন, কে তোমাকে এগুলো করে দিলো। আমিতো এখনো তোমাকে এগুলো শেখাইনি। ত্রস্ত হৃদয়ে বললাম, আম্মা করে দিয়েছেন। আব্বা প্রিয়তমা স্ত্রীকে ডেকে তৎক্ষনাৎ ধন্যবাদ দিয়ে, প্রশংসা করে অদ্ভুত এক স্বর্গীয় হাসি হেসে পরিবেশ হাল্কা করে দিয়েছিলেন। আব্বা বলেছিলেন, যথাযথ করেছো। একদম সঠিক হয়েছে।
এখন কি দেখি আমরা? বাবা মায়েরা যন্ত্রের মতো কাজের পেছনে ছুটছেন। নিঃসন্দেহে উভয়েই পরিবারের জন্য নিজেদের উজাড় করে দিচ্ছেন। কিন্তু মা দের বিষয়টি একদম ভিন্ন। খুব সকালে বিছানা ত্যাগ করে চুলোর পাড়ে, তারপর অফিস। আবার বাড়িতে রান্না ঘর,ডাইনিং। দুগ্ধপোষ্যকে স্তন দান, রাতে স্বামীসঙ্গ। বাড়ির এমন কোন কাজ নেই যেখানে মায়ের হাতের ছোয়া নেই। কঠিন সরল সব কাজেই মা। মা মা বলে সারাদিন ছেলেমেয়েদের চিৎকার চেচামেচি তো আছেই। আমরা এগুলো কি এড়িয়ে যেতে পারবো। বাবারা বেশ কিছু পারিবারিক সমস্যা মোকাবেলা করেন না। মা যেখানে একাই একশো। মা তাঁদের দৃঢ়তা,মহানুভবতা আর মোহনীয় আকর্ষণ নিয়ে সন্তানদের পাশে একাই দাঁড়িয়ে থাকেন।
এরকম আমরা কি প্রায়ই দেখি যে বাবা তাঁর কোলে সন্তান নিয়ে সব কাজ সারছেন? যদি দেখি তাহলে আর আমার কথা নেই। যদি প্রায়শই না দেখি তবে সমাজের নিকট বড় প্রশ্ন থাকবে, কেন এটি দেখি না?
তবে কি বলতে পারবো ত্যাগটুকু কার বেশি? একটি পরিবার আর সমাজের জন্য কে ত্যাগী? বাবা না মা? মা তোমায় সালাম।
সময় পাল্টেছে,সমাজ পাল্টে যাচ্ছে। আমরা সবাই চাই, আমাদের সন্তানেরা মানুষের মতো মানুষ হোক। আমরা ভেবে দেখি দায়িত্বটি কার বেশি। অযথা বিতর্ক বাড়িয়ে লাভ হবে কি? আমি অনুরোধ করি আমাদের কাজ আর বিনোদনের জায়গায় কোন শিশু যেনো অবহেলার শিকার না হয়। আমরা যদি সন্তানদের মানুষ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত না করতে পারি তবে বংশধর টিকবে বা। আমাদের নামও এ গ্রহ থেকে মুছে যাবে।