খানসামা (দিনাজপুর) প্রতিনিধিঃ
অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে খলিলুল্লাহ আজাদ মিল্টন নামে দিনাজপুরের এক সাবেক যুবলীগ নেতার বিরুদ্ধে অভিযোগের পাহাড়।

জানা যায়, বিভিন্ন প্রলোভনে টাকা হাতিয়ে প্রতারণা, হোটেল ব্যবসায়ীকে নির্যাতন করে জমি দখল এবং বন্ধ চালকল মিলের নামেও বরাদ্দ নিয়েছেন খলিলুল্লাহ আজাদ মিল্টন। তার এসব অনৈতিক ও অবৈধ কর্মকান্ড নিয়ে ইতিমধ্যে জেলা জুড়ে বইছে ক্ষোভ ও নিন্দা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, সম্প্রতি ঢাকায় সংবাদ সম্মেলনে দিনাজপুরের ব্যবসায়ী খলিলুল্লাহ আজাদ ওরফে খাইরুল আজাদ মিল্টন (৪৫) অভিযোগ করেছেন, ‘উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে’ জেলা পুলিশ তার বিরুদ্ধে ১৩টি জিআর ও ৫টি ননজিআর মিলে ১৮টি মামলা দায়ের করেছে। অথচ মামলার কাগজপত্র পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, জেলার কোতোয়ালি থানা ও খানসামা থানায় মামলাগুলোর বাদী বিভিন্ন ভুক্তভোগী। যাদের অধিকাংশই খাইরুল আজাদ মিল্টনের প্রতারণার শিকার। আরো বিস্ময়কর তথ্য হচ্ছে, মিল্টন কেবল সাধারণ মানুষের সাথেই প্রতারণা করেননি, প্রতারণা করে রাষ্ট্রের অর্থও আত্মসাত করেছেন। জেলা প্রশাসনের একজন শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা এবং বিশেষ সম্পর্ক থাকার সুবাদেই তিনি ফ্রিস্টাইল অপকর্ম করার সুযোগ পেয়েছেন।

সরকারের একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী খলিলুল্লাহ আজাদ ওরফে খাইরুল আজাদ মিল্টন একজন সন্ত্রাসী, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ভূমিদস্যু ও গাড়িচুরি সিন্ডিকেটসহ সংঘবদ্ধ অপরাধ চক্রের মূল হোতা। কতিপয় সাংবাদিক, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তি এবং স্থানীয় প্রশাসনের সহযোগিতায় রাজনৈতিক পরিচয় ব্যবহার করে অপরাধমূলক কর্মকান্ড করে থাকে।

অন্য আরেকটি প্রতিবেদনে বলা হয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ছাত্র পরিচয় দিয়েই খলিলুল্লাহ আজাদ জেলার এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে সখ্যতা ও বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তোলে। তার এ সখ্যতাকে কাজে লাগিয়ে জেলা প্রশাসন কর্তৃক সরকারি চাকুরিতে নিয়োগ পাইয়ে দেবার নাম করে নিরীহ চাকুরি প্রার্থীদের কাছ থেকে প্রচুর অর্থ হাতিয়ে নেয় মর্মে জানা যায়। এছাড়াও জলমহাল/বালমহাল, হাট-বাজার ইজারাসহ বিভিন্ন সরকারী অফিসে টেন্ডার ও অস্ত্রের লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে তদ্বির করে থাকে। এভাবে সে তার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতা অপব্যবহার করে বিভিন্ন লোকজনের নিকট থেকে প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নেয়।

অপরদিকে স্থানীয় সূত্রের তথ্য এবং অনুসন্ধানেও দুটি প্রতিবেদনের ভাষ্যের যথার্থতা প্রমাণ মিলেছে। একটি ঘটনার উল্লেখ করে সূত্র জানিয়েছে, প্রশাসনের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সঙ্গে খলিলুল্লাহ আজাদের সখ্যতা ছিল ওপেন সিক্রেট। এ সখ্যতাকে কাজে লাগিয়েই সে বহু অবৈধকে বৈধ করেছে। তার একটি নজির হচ্ছে বন্ধ চালকলের নামে বরাদ্দ বাগিয়ে নেয়া। জানা গেছে, খলিলুল্লাহ আজাদ ২০০৫ সালের দিকে খানসামায় নিজ গ্রামের বাড়িতে ‘মেসার্স সরদার হাসকিং মিল’ নামে একটি চালকল প্রতিষ্ঠা করেন। তবে অর্থাভাবে সেটি কয়েক বছর ধরেই বন্ধ। মিলের ঘরটি বর্তমানে জীর্ণ কুঠিরে রূপ নিয়েছে। সরেজমিনে দেখলে সহজেই বুঝা যাবে দীর্ঘদিন ধরে এটি অব্যবহৃত। অথচ এ বন্ধ মিলের নামেও গত দুই-তিন বছর চালের বরাদ্দ মিলেছে।

এ সম্পর্কের আরো গভীরতা প্রমাণ মিলে ভিন্ন এক ঘটনায়। চলতি বছরের জানুয়ারিতে দিনাজপুর জেলা কারাগারে সংঘটিত ওই ঘটনা নিয়ে অবশ্যই প্রশাসনে ব্যাপক তোলপাড় হয়। ঘটনার বর্ণনা দিয়ে স্থানীয় সূত্র জানায়, গত বছরের ১৯ নভেম্বর ঢাকার মোহাম্মদপুরের একটি বাসা থেকে খলিলুল্লাহ আজাদকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পরে তাকে দিনাজপুর নিয়ে আসা হয়। এ অবস্থায় কারাবন্দি আসামির সঙ্গে পরিদর্শন টিমের কারো কারো ‘একান্ত বৈঠক’ অনেকের কাছে আপত্তিজনক ছিল। আরো চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিচয় হিসেবে খলিলুল্লাহ আজাদ নিজেকে আওয়ামী ঘরানার হিসেবে দাবি করেন। অথচ তার পারিবারিক পরিচিতি ভিন্ন মেরুর। যা নিয়ে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।

এদিকে দিনাজপুরের খলিলুল্লাহ আজাদ ওরফে খাইরুল আজাদ মিল্টন (৪৫) নিজেকে ব্যবসায়ী হিসেবে পরিচয় দেন। তবে তার সচল ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কোনো তথ্য নেই। অথচ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামে বিভিন্ন ব্যাংকের শাখায় অন্তত দেড় ডজন হিসাব (একাউন্ট) খোলার তথ্য মিলেছে। রহস্যজনক বিষয় হচ্ছে, এসব একাউন্টের মধ্যে বেশ কয়েকটি খোলা হয়েছে গত বছর কয়েক মাসের ব্যবধানে। সেসব হিসাবে লেনদেনও হয়েছে কোটি কোটি টাকা। প্রতারণা আর তদ্বিরবাজি করেই এ বিপুল অংকের অর্থ আয় করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে।

খলিলুল্লাহ আজাদ মিল্টনের বিরুদ্ধে চলতি বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর দিনাজপুরের কোতোয়ালী থানায় মানি লন্ডারিং আইনে একটি মামলা হয়। মামলা নং-৩৮। অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডি দিনাজপুরের উপ-পুলিশ পরিদর্শক রোকনুজ্জামান বাদী হয়ে মামলাটি দায়ের করেন। গত ২১ নভেম্বর ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়নে আহূত সংবাদ সম্মেলনে খলিলুল্লাহ আজাদ মিল্টন তার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া এ মামলাটিকেও অসত্য বলে দাবি করেছিলেন। তবে তার এ দাবি নাকচ করে মামলার বাদী উপ-পুলিশ পরিদর্শক রোকনুজ্জামান ওই সময় গণমাধ্যমকে বলেন, তদন্তে মানি লন্ডারিংয়ের বিষয়টি প্রমাণ হওয়ার পরবর্তীতে খলিলুল্লাহ আজাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। তিনি আরো বলেন, আমরা যখন বাংলাদেশ ব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল ক্রাইম ইউনিটে চিঠি লিখি, ওখান থেকে একটি প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ওই প্রতিবেদনের প্রকৃতি এবং আমাদের অনুসন্ধানের প্রেক্ষিতে যে ধরনের তথ্য উপাত্ত পেয়েছি তার ভিত্তিতেই এজাহার দায়ের করা হয়। এদিকে স্থানীয়দের ভাষ্য এবং মামলার নথি পর্যালোচনায় খলিলুল্লাহ আজাদ মিল্টনের অপকর্মের চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। সূত্র মতে, খলিলুল্লাহ আজাদ একজন ভদ্রবেশী প্রতারক হিসেবে কোতোয়ালী ও খানসামা থানা এলাকায় একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন। টেন্ডারবাজি, বালু ও জলমহাল দখলকারী, ভূমিখোকো, সুদের কারবারসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল চক্রের সদস্যরা। পরবর্তীতে ধুরন্ধর খলিলুল্লাহ আজাদ জেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে সখ্যতা ও যোগাযোগ গড়ে তুলে তার অপরাধ সাম্রাজ্যের বিস্তার ঘটিয়েছেন। হাট-বাজার ইজারা কিংবা সরকারি চাকুরি পাইয়ে দেয়ার নামে বহু নিরীহ লোকের কাছ থেকে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার ধূর্ততার প্রমাণ মিলে একটি ব্যাংকের শাখায় মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে একাধিক একাউন্ট খোলার ঘটনায়।

নথি পর্যালোচনায় দেখা গেছে, খলিলুল্লাহ আজাদ (এনআইডি নম্বর-৬৮৮৯০৭০৬৪২) গত বছরের ১৪ জানুয়ারি দিনাজপুর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক শাখায় ৫৩৫৩১০০১২৬৩১ হিসাব খোলেন। একদিন পর অর্থাৎ ১৫ জানুয়ারি একই ব্যাংকে ৫৩৫৩১০০১২৬৫৩ ও ৫৩৫৩১০০১২৬৬৪ নম্বরে দুইটি হিসাব খোলেন। এর আগে ২৬ জুলাই একই শাখায় ৫৩৮৩৪০০০০৫৭২ নম্বরে এবং ১০ আগস্ট ০৫৩১৩৬০০০০৪৫৮ নম্বরে হিসাব খোলেন। অন্যদিকে ‘মেসার্স সরদার হাসকিং মিলস’ এর নামে গত বছরের ২৭ আগস্ট ৫৩৪২৪০০০০০৩২ দিনাজপুর সোস্যাল ইসলামী ব্যাংক শাখায় এবং ১৮ অক্টোবর একই ব্যাংকের লিলির মোড় শাখায় ০৫৩৩০৫০০৩৯৮৬৫ নম্বরের হিসাব খোলেন। চমকপ্রদ তথ্য হচ্ছে, অধিকাংশ একাউন্টে লাখ লাখ টাকার লেনদেন হলেও সিআইডির তদন্তকালে সেগুলোর কয়েকটির হিসাব শূন্য ছিল। অর্থাৎ টাকা উত্তোলন করে আগেই পাচার হয়েছে।

অভিযুক্ত খলিলুল্লাহ আজাদ মিল্টন এসব অস্বীকার করে বলেন, আমাকে মিথ্যা ভাবে ফাঁসানোর জন্য এসব সাজানো নাটক। তারা তো জানে আমার হাত কতটা লম্বা।

ওসি খানসামা কামাল হোসেন বলেন, মিল্টন হলেন একজন বিশ্ব মানের প্রতারক। প্রতারণার স্বীকার ব্যক্তিদের লিখিত অভিযোগ আমলে নিয়ে তদন্ত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *