(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়)
সিরাজী এম আর মোস্তাক, ঢাকাঃ কোটাসংস্কার আন্দোলনের মুখে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ১২ এপ্রিল, ২০১৮ তারিখে জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে সকল কোটা বাতিলের ঘোষণা দেন। এরপর ২৭ জুন, ২০১৮ তারিখে জাতীয় সংসদে পোষা বিরোধীদলীয় নেত্রীর প্রশ্নোত্তরে মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহালের ঘোষণা দেন। এ দ্বিমুখী ঘোষণায় ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করলে, তা কঠোর হস্তে দমন করেন। তিনি বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে গর্ববোধ এবং মুখে ঠিকই মুক্তিযুদ্ধের বুলি আওড়ান। ৩০লাখ শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। লাখো সম্ভ্রমহারা মা-বোনদের শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেন। আবার ২লাখ তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার জন্য ভাতা এবং তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য কোটা বহালে অটল থাকেন। এ বহুরূপী আচরনে লেখকের সবিনয় জিজ্ঞাসা- মুক্তিযোদ্ধা কোটাবঞ্চিতরা কি বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর সন্তান নয়? তারা কি মুক্তিযুদ্ধে লড়াকু যোদ্ধা ও বীর শহীদের প্রজন্ম নয়? শুধু ২লাখ তালিকাভুক্ত পরিবারের সদস্যই কি মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম? তাহলে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবঞ্চিতদের পরিচয় কি? যেমন, বঙ্গবন্ধুর নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নেই। মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তানে বন্দী ছিলেন, তাই বলে কি তিনি মুক্তিযোদ্ধা নন? জাতীয় চারনেতা, এম এ জি ওসমানী, ৩০ লাখ শহীদ ও লাখ লাখ সম্ভ্রমহারা মা-বোনের নামও মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় নেই। তারাও কি মুক্তিযোদ্ধা নন? তাদের সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ কি বৃথা? তাদের সন্তান-সন্ততি কি মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম নয়? বঙ্গবন্ধুসহ এসকল তালিকাবঞ্চিত যোদ্ধা ও বীরশহীদ কি বর্তমান তালিকাভুক্ত ২লাখ মুক্তিযোদ্ধার চেয়ে নিম্নমানের? তাহলে মুক্তিযোদ্ধা কোটাবঞ্চিত ১৬কোটি জনতার পরিচয় কি? তারা কি অমুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম?
মুক্তিযোদ্ধাকোটা দেশে বিভাজন সৃষ্টির কারণ। ৫৬ভাগ কোটার মধ্যে ৩০ভাগই মুক্তিযোদ্ধা কোটায়। অথচ এ কোটাভোগীর সংখ্যা দেশের জনসংখ্যার তুলনায় খুবই নগন্য। ১৬ কোটির মধ্যে মাত্র ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত। এ তালিকা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। স্বীকৃত হয়েছে, ১৯৭১ সালে এ ২লাখ যোদ্ধাই বাংলাদেশ স্বাধীন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে আর কারো ভূমিকা নেই। ৩০লাখ বীর শহীদের তালিকা বা স্বীকৃতি নেই। তারা মুক্তিযোদ্ধা নন। তাদের সকল অবদান ও আত্মত্যাগ বৃথা। তাদের সন্তান-সন্ততি ও স্বজনদের অস্তিত্ব নেই। এভাবে লাখো সম্ভ্রমহারা মা-বোনের আত্মত্যাগও বৃথা। তাদের পরিবারেরও অস্তিত্ব নেই। মুক্তিযুদ্ধে যা কিছু অবদান ও স্বীকৃতি, শুধু ২লাখ তালিকাভুক্ত যোদ্ধা ও তাদের সন্তানদের জন্য। অন্যরা অমুক্তিযোদ্ধা ও তাদের প্রজন্ম।
স্বাধীনতার স্থপতি বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন। ৭মার্চে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবানা। আমরা রক্ত যখন দিয়েছি, আরো দিব, এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাল্লাহ।’ ২৩ মার্চ (১৯৭১) আওয়ামী গণবাহিনীর কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি ঐক্যবদ্ধভাবে যে আন্দোলন শুরু করেছে, দেশমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তা থামবেনা। একজন বাঙ্গালীও জীবিত থাকা পর্যন্ত এ সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। বাঙ্গালিরা শান্তিপুর্ণভাবে অধিকার আদায়ের জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারেও তারা প্রস্তুত। (কামাল হোসেন, ‘তাজ্উদ্দিন আহমদ- বাংলাদেশের অভ্যুদয় এবং তারপর’, পৃষ্ঠা-২৪৫, ঢাকাঃ অঙ্কুর প্রকাশনী-২০০৮)। বঙ্গবন্ধু ১০ জানুয়ারী, ১৯৭২ তারিখে লাখো জনতার সামনে ৩০লাখ শহীদদের বারবার স্মরণ করেন এবং শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। তিনি ৩০লাখ শহীদের পক্ষ থেকে ৭জনকে বীরশ্রেষ্ঠ খেতাব প্রদান করেন। এতে প্রমাণ করেন, যারা দেশ স্বাধীনের জন্য ভূমিকা রেখেছেন সবাই মুক্তিযোদ্ধা। যারা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, তারা মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ উভয়। যারা বন্দি, শরণার্থী ও আত্মত্যাগী ছিলেন, তারাও মুক্তিযোদ্ধা। অর্থাৎ ৩০লাখ বীর শহীদের চেয়ে মুক্তিযোদ্ধা সংখ্যা অনেক বেশি। তাই বঙ্গবন্ধু সকল মুক্তিযোদ্ধার পক্ষ থেকে ৬৬৯ জনকে (বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতীক) খেতাব প্রদান করেন। তিনি এ খেতাবপ্রাপ্ত যোদ্ধাসহ দেশের সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ও বীর শহীদের পরিবারভুক্ত করেন। তিনি শহীদ ও মুক্তিযোদ্ধাদের আর কোনো তালিকা করেননি। তাদের জন্য ভাতা বা কোটা চালু করেননি। তখন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় ছিলনা।
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, (তালিকাভুক্ত) মুক্তিযোদ্ধাগণ দেশ স্বাধীন না করলে আমরা বাংলাদেশ পেতামনা। তাই, তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা এবং মুক্তিযোদ্ধাভাতা ও কোটা মেনে নেয়া উচিত। তিনি আরো বলেন, ১৯৭২ সাল থেকে মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু হয়েছে। অথচ বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্থ দেশ গড়তে সম্পুর্ণ বৈষম্যমুক্ত নিয়োগ প্রদান করেছেন। তিনি মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা বিভাজন করেননি। বঙ্গবন্ধুর নীতি অনুসারে প্রচলিত ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা, প্রদত্ত ভাতা ও কোটা মোটেও বৈধ নয়।
অতএব মাননীয় প্রধানমন্ত্রী সমীপে আকুল আবেদন, বিতর্কিত মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও কোটা বাতিল সংক্রান্ত জাতীয় সংসদে প্রদত্ত ঘোষণাটি দ্রুত বাস্তবায়ন করুন। সেশনজট ও অবৈধ কোটাবৈষম্যের শিকার বেকারদের চাকরিতে প্রবেশে বয়সসীমা কমপক্ষে ৪৫ বা ৪০ করুন। মুক্তিযোদ্ধাকোটা বঞ্চিতদের অমুক্তিযোদ্ধা প্রজন্ম লান্থণা থেকে পরিত্রাণ দিন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *