লেখক -মোহাম্মদ জা‌হির মিয়া তালুকদার 

______________________________

ডি‌সেম্বর মাস বাঙা‌লি জা‌তির জন‌্য বিশাল গৌর‌বের মাস, আত্মমর্যাদায় মাথা উঁচু ক‌রে দাঁড়া‌নোর মাস, স্বাধীন চিন্তা চেতনায় জাগ্রত হওয়ার মাস , নি‌জের অ‌স্থিত্ব‌কে জানান দেয়ার মাস । কারণ, এ মা‌সে বাঙা‌লি জা‌তি নি‌জেকে পরাধীনতার শৃঙ্খল থে‌কে মুক্ত ক‌রে বি‌শ্বের আকা‌শে বিজয় পতাকা উ‌ড়ি‌য়ে বি‌শ্বসভায় নি‌জের সম্মান‌কে প্রতি‌ষ্ঠিত ক‌রে‌ছিল । 

ডি‌সেম্বর মাস আ‌রো এক‌টি কার‌ণে বিশাল গুরুত্ব বহন ক‌রে । আর তা হ‌লো ম‌হিয়সী নারী , নারী জাগর‌ণের অগ্রদূত বেগম রো‌কেয়ার জন্ম ও মৃত‌্যু হ‌য়ে‌ছিল ডি‌সেম্বর মা‌সের ৯ তা‌রি‌খে। 

মানুষ সৃ‌ষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব, তার অ‌র্ধেক অংশ নারী । নারী‌কে অন্ধকা‌রে রে‌খে সমাজ দেশ তথা রাষ্ট্র চল‌ছিল একটা নিস্তরঙ্গ নিয়‌মে। এম‌নি প‌রি‌বে‌শে বৃ‌টিশ শাস‌নের শেষ দি‌কে ১৮৮০ সা‌লে এক বাঙা‌লি সম্ভ্রান্ত রক্ষণশীল মুস‌লিম জ‌মিদার প‌রিবা‌রে বেগম রো‌কেয়া জন্ম গ্রহণ ক‌রেন । 

সে সময় নারী‌শিক্ষার দার আজ‌কের মত খোলা ছিল না । শিক্ষার চে‌য়ে পর্দা বা গৃহাবদ্ধ বা অব‌রোধবা‌সিনী থাকাটাই নারীর জন‌্য সব‌চে‌য়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল যা সামা‌জিক প‌রিমন্ড‌লে এর অনুশীলন অব‌্যাহত ছিল অ‌নেকটা বিনা বাক‌্য ব‌্যয়ে মে‌নে নেয়ার মত।   

সামা‌জিক এই বুহ‌্য অ‌তিক্রম ক‌রে প্রা‌তিষ্ঠা‌নিক শিক্ষার আওতায় আসার জন‌্য সামা‌জের রক্তচক্ষু উ‌পেক্ষা করার মত সাহস , সামর্থ সাধারণ মানু‌ষের তো ছিলই না এমন কি এ‌লিট শ্রেণীরও কোন ধর‌নের ম‌নের জোর বা নারীকে এ‌গি‌য়ে নি‌য়ে যাওয়ার মত মুক্ত চিন্তা ছিলনা । বি‌শেষ ক‌রে মুস‌লিম প‌রিবা‌রের নারীর প্রতি স‌চেতনতা তো ছিল ভয়ংকর রক‌মের রক্ষণশীল । লেখা পড়া শিখ‌লেই নারী বাধ‌্যতার শৃঙ্খল ভে‌ঙ্গে এ‌গি‌য়ে যা‌বে সেরকম ভয় সকল শ্রেণী পেশার মানু‌ষের ম‌নে বদ্ধমূল ছিল যা থে‌কে বেগম রো‌কেয়ার প‌রিবারও মুক্ত ছিল না । 

অ‌নেকটা নি‌জের চেষ্টায় এবং তার বড় ভাই‌য়ের সহ‌যো‌গিতায় বেগম রো‌কেয়া বা‌ড়ি‌তেই পড়া‌লেখায় হা‌তেখ‌ড়ি শুরু। বিবা‌হিত জীব‌নে যা অপার স্বাধীনতা এ‌নে‌ দেয় স্বামী সাখাওয়াত হো‌সেন এর সাহচার্য ও উৎসাহ উদ্দীপনায়। 

বেগম রো‌কেয়া নারী সমা‌জের জন‌্য সবসময় প্রস‌ঙ্গিক ব‌লে ম‌নে ক‌রি । বেগম রো‌কেয়ার গড়া প‌থেই আমা‌দের নারী সমাজ আজ ভীষণভা‌বে এ‌গি‌য়ে যা‌চ্ছে । শিক্ষা শুধু জ্ঞানার্জনের একটা উপলক্ষ‌্যই নয়, এটা সকল ধর‌নের‌ বাঁধা বিপ‌ত্তি অন্ধকার দূর করার একটা হা‌তিয়ারও ব‌টে ।   

উপমহা‌দে‌শের নারী শিক্ষার অর্গল খো‌লে দেয়া হয় সাখাওয়াত মেম‌রিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠার মাধ‌্যমে । সেই পাঁচ জন নারী থে‌কে আটজন এবং ক`বছর পর সেটা আ‌শি‌তে রূপান্ত‌রিত হ‌য়ে‌ছিল । আজ উপমহা‌দে‌শে সে নারী শিক্ষা সংখ‌্যার গণনায় হাজার লক্ষ পে‌ড়ি‌য়ে কো‌টি‌তে পৌঁ‌ছে গে‌ছে । মাত্র প্রায় এক`শ বছর আ‌গে যে আদ‌র্শের বীজটা রূপন করে গি‌য়ে‌ছি‌লেন বেগম রো‌কেয়া আজ সেটা বিশাল ম‌হীরো‌হের আকার ধারণ ক‌রে‌ছে । 

চোখ খো‌লে তাকা‌লেই নারী শিক্ষার প্রসার দেখ‌তে পাওয়া যায় । আজ আমা‌দের দে‌শের প্রাথ‌মিক বিদ‌্যাল‌য়ের শতকরা ষাটভাগেরও উপ‌রে নারীরা কর্মরত আ‌ছেন যা এক সময় স্বপ্ন ছিল । নারী চাকুরী করাটা আজ আর আ‌গের ম‌তো অ‌লীক স্বপ্ন নয়, এখন সেটা সমান অধিকা‌রের ম‌ধে‌্যই এ‌সে দাঁ‌ড়ি‌য়ে‌ছে । 

এখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠা‌নের প্রধান নারী, আ‌র্থিক প্রতিষ্ঠা‌নের প্রধান নারী, ব‌্যবসা প‌রিচালনায় নারী, জনপ্রতিনি‌ধি ‌ হি‌সে‌বে দা‌য়িত্ব পালন কর‌ছেন নারী । প্রতিরক্ষায় নারী, পু‌লিশ প্রশাস‌নে নারী , সি‌ভিল প্রশাস‌নে নারী , বিচার ব‌্যবস্থায় নারী, আইনী লড়াই‌য়ে দাঁ‌ড়ি‌য়ে যান নারী । দেশ প‌রিচালনায় নারী, দে‌শের প্রধান মন্ত্রী নারী, দে‌শে‌র বি‌রোধী দ‌লের নেতা নারী , জাতীয় সংস‌দের স্পীকার নারী , মন্ত্রণাল‌য়ের দা‌য়ি‌ত্বে তাও একজন নারী । 

আজ‌কের দি‌নে এসে নারী‌দের এত গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় অ‌ধি‌ষ্ঠিত হওয়ার মূল উৎস হ‌চ্ছে বেগম রো‌কেয়ার -শিক্ষা আ‌ন্দোলন, সমাজ সংস্কার আ‌ন্দোলন, নারী পুরুষ সমতার আ‌ন্দোলন, নারীর চার দেয়া‌লের বাই‌রে পা রাখার আ‌ন্দোলন । তি‌নি নারী শিক্ষার ক্ষেত্রটা প্রসা‌রিত করার চেষ্টা ক‌রেছি‌লেন ব‌লেই আজ‌কে আমরা এটা‌কে মস্তবড় ভি‌তের উপর দাঁ‌ড় ক‌রিয়ে নারী‌দের হা‌তে সমা‌জের অগ্রযাত্রার পতাকা তু‌লে দি‌তে পারছি । 

বেগম রো‌কেয়ার চিন্তায় ছিল- নারীকে সমান দা‌য়িত্ব পালন কর‌তে হ‌লে তা‌কে ক্ষমতায়‌নের দি‌কে নি‌য়ে যে‌তে হ‌বে, আর সেটা হ‌বে সু‌শিক্ষায় শি‌ক্ষি‌ত করার মাধ‌্যমে। পর্দা প্রথা‌কে তি‌নি ম‌নে প্রা‌ণে না মান‌তে পার‌লেও কাজ করার স্বার্থে তা‌কে তখন সমা‌জের সা‌থে আ‌পোস ক‌রে কাজ কর‌তে হ‌য়ে‌ছিল ।

 য‌দি তখনই পু‌রোটা অমান‌্য ক‌রে এ‌গি‌য়ে যে‌তেন তাহ‌লে নারী উন্নয়‌নের অগ্রযাত্রা থম‌কে দাঁ‌ড়ি‌য়ে যেত । বু‌দ্ধিমত্তার সা‌থে তি‌নি বর্তমান‌কে উ‌পেক্ষা না‌ ক‌রে সেটা মে‌নেই ভ‌বিষ‌্যতে সকল অ‌নিয়ম অব‌রোদ্ধ প‌রি‌বেশ‌কে রাহুমুক্ত করার ল‌ক্ষ্যে কাজ ক‌রে গে‌ছেন । সমা‌জের নারী সমাজ‌কে সংগ‌ঠিত ক‌রে জা‌গি‌য়ে তোলার চেষ্টা ক‌রে গে‌ছেন । যার জন‌্য আ‌জকের নারীরা শিক্ষা-দীক্ষা, সা‌ম্যে-সভ‌্যতায়, চিন্তা-‌চেতনায় পরিবার , সমাজ, দেশ ও জা‌তি‌কে ছা‌ড়ি‌য়ে বিশ্বময় ছ‌ড়ি‌য়ে প‌ড়ে‌ছে । নারীর এ ঈর্ষণীয় অগ্রযাত্রার মূল চা‌লিকাশ‌ক্তি হ‌চ্ছেন বেগম রো‌কেয়া । 

আমারা স্বাধীন জা‌তি হি‌সে‌বে আজ প্রায় পঞ্চাশ বছ‌রেরও বেশী সময় ধ‌রে বি‌শ্বের বু‌কে মাথা উঁচু ক‌রে দাঁ‌ড়ি‌য়ে আ‌ছি । কিন্তু বেগম রো‌কেয়ার নী‌তি , আদর্শ, আ‌ন্দোলন , সমাজসংস্কার এখ‌নো শতভাগ বিস্তার কর‌তে পা‌রি‌নি । আজো খব‌রের কাগ‌জে, টে‌লি‌ভিশ‌নে, সামা‌জিক যোগা‌যোগ মাধ‌্যমে অ‌নেক নারীর রুদ্ধতার কা‌হিনী পড়‌তে হয় , দেখ‌তে হয়, শুন‌তে হয় । একুশ শত‌কে এ‌সেও নারী‌কে ‌নিপিড়‌নের শিকার হ‌তে হয়, দা‌বি‌য়ে রাখার পায়তারা করা হয়, শারী‌রিকভা‌বে মান‌সিকভা‌বে অত‌্যাচা‌রিত হ‌তে হয়। শি‌ক্ষি‌ত নারী‌দের বিচর‌ণের ক্ষেত্রটা আজও আমরা প্রস্তুত কর‌তে পা‌রি‌নি সমসাম‌য়িক চেতনার আদ‌লে । 

আ‌জো ম‌নে হয় প্রতি‌টি ঘ‌রে ঘ‌রে বেগম রো‌কেয়ার কণ্ঠ এবং কলম প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন । রাষ্ট্রীয় প‌রিমন্ড‌লে নারী‌কে আ‌রো বেশী সম্মা‌নিত পর্যা‌য়ে দেখ‌তে হ‌লে সমাজ‌কে সেভা‌বে প্রস্তুত কর‌তে হ‌বে, স‌চেতন করে গ‌ড়ে তোল‌তে হ‌বে নারী‌দের‌কে । সেই সা‌থে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব‌্যবস্থায় নারীর সমঅ‌ধিকার প্রতিষ্ঠায় পুরুষ‌কে এ‌গি‌য়ে আস‌তে হ‌বে সমান তা‌লে । তাহ‌লেই অব‌রোধবা‌সিনী‌কে স্ব‌প্নের সুন্দর সমাজ উপহার দেয় সম্ভব হ‌বে। 

আজ‌কের দি‌নে রো‌কেয়া দিবস কে এক‌টি দি‌ন বা তা‌রি‌খের ম‌ধ্যে আবদ্ধ না রে‌খে সমা‌জে, রা‌ষ্ট্রে, কর্মক্ষে‌ত্রে , প‌রিবা‌রে নারী‌কে তার ন‌্যায‌্য অ‌ধিকার দি‌তে পার‌লেই আজ‌কের রো‌কেয়া দিবস পূর্ণতা পা‌বে ব‌লে ম‌নে ক‌রি । 

নারী উন্নয়‌নে বেগম রো‌কেয়া যে সবসময়ই প্রস‌ঙ্গিক সেটা অস্বীকার করার কোন উপায় নাই । এই ম‌হিয়সী নারীর আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জা‌নি‌য়ে আজ‌কে আ‌লোচনার এখা‌নেই ই‌তি টান‌ছি । 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *