হুমায়ুন কবীর সুর্য্য,কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি :
প্রযুক্তির সহায়তায় কুড়িগ্রামের চাঞ্চল্যকর স্ত্রী হত্যা মুল আসামী স্বামী মোখলেছুর রহমান (৪৫) কে গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। কুড়িগ্রাম সদর থানা পুলিশ বৃহস্পতিবার ভোর রাতে দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার টিকুর শালখুরিয়া গ্রাম থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
এ তথ্য নিশ্চিত করে কুড়িগ্রামের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রুহুল আমিন জানান, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের পশ্চিম পলাশবাড়ী গ্রামে নিজ শয়ন ঘর থেকে বুধবার রাতে মোছা: সাহেরা বেগম(৩৫) নামের এক গৃহবধূর গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। নিহত সাহেরা বেগম উপজেলার বেলগাছা ইউনিয়নের পলাশবাড়ী পশ্চিম পাড়া গ্রামের মৃত আব্দুস ছাত্তারের মেয়ে। এ ঘটনার পর থেকে নিহতের স্বামী মো: মোখলেছুর রহমান পলাতক ছিলো। ঘটনা জানার পরপরই পুলিশ সুপার আল আসাদ মো: মাহফুজুল ইসলাম ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে আসামী গ্রেপ্তারের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেন।
কুড়িগ্রাম সদর থানার অফিসার ইনচার্জ খান মোঃ শাহরিয়ার জানান, নিহতের মা সহ পরিবারের লোকজনের দাবি পারিবারিক কলহের জেরে সাহেরার স্বামী তাকে গলাকেটে হত্যা করে ঘর তালাবদ্ধ করে পালিয়ে যায়। ঘটনা জানার পর রাতেই পুলিশ লাশ উদ্ধার করে আসামী ধরতে সাড়াশি অভিযানে নামে। প্রযুক্তির সহায়তায় পুলিশ অভিযান পরিচালনা করে বৃহস্পতিবার ভোর রাতে দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলার টিকুর শালখুরিয়া গ্রাম থেকে খুনের অভিযোগে অভিযুক্ত একমাত্র আসামী মোখলেছুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে। বৃহস্পতিবার দুপুরে কুড়িগ্রাম চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের অতিরিক্ত চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মিজানুর রহমানের আদালতে সোপর্দ করা হলে আদালত আসামীতে জেলহাজতে প্রেরণের আদেশ দেন। খুনের সময় ব্যবহৃত দা উদ্ধার করেছে পুলিশ। লাশ ময়না তদন্তের জন্য মর্গে প্রেরণ করা হয়েছে।
তিনি আরো জানান, নিহতের মা ফাতেমা বেগম বাদী হয়ে জামাই মোখলেছুর রহমানকে আসামী করে কুড়িগ্রাম সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। সেখানে উল্লেখ করা হয় আসামী দীর্ঘদিন থেকে বেকার। সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। এর মধ্যে সে লুডু দিয়ে জুয়া খেলতো। এনিয়ে স্ত্রীর সাথে প্রায়ই বসচা এবং হাতাহাতির ঘটনা ঘটতো। একাধিকবার স্ত্রী সাহেরাকে হত্যার হুমকী দেয়। হত্যার পরিকল্পনা মোতাবেক কিছুদিন পূর্বে একটি মাংস কাটার দা ধার দিয়ে রাখে। এই দা দিয়ে বুধবার সাহেরাকে কুপিয়ে হত্যা করা হয়।
নিহতের ছেলে শামীম ইসলাম জানান, বুধবার সন্ধ্যায় বাড়িতে ফিরে গেট তালাবদ্ধ দেখতে পান। ডাক চিৎকার করেও মা সাহেরা বেগম সাড়া না দেয়ায় প্রতিবেশীরাসহ দরজা ভেঙ্গে ভিতরে প্রবেশ করেন। শয়ন ঘরের মেঝেতে এবং বিছানায় লেপে রক্ত দেখতে পান। এরপর লেপ খুলে দেখেন মায়ের গলাকাটা রক্তাক্ত লাশ।পরে স্থানীয়রা পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে মরদেহ উদ্ধার করে।
শামীম বৃহস্পতিবার কুড়িগ্রাম সদর থানায় পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার বাবা মোখলেছুর রহমানকে খুনি বলে চিৎকার করতে থাকে। এবং মাকে হত্যার দায়ে বাবার ফাসির দাবি করেন। এ সময় উপস্থিত সাংবাদিকদের বলেন, বুঝ হবার পর থেকে দেখি বাবা মাকে শারীরিক নির্যাতন করতো। প্রায় ১৫দিন আগে গরুর মাংস কাটার একটি দা বাড়িতে এনে ধার দিয়ে রাখে। ধার দিতে গিয়ে তারা হাতও কেটে যায়। কিন্তু আমরা স্বপ্নেও ভাবতে পারিনি এ দা দিয়ে মাকে হত্যা করা হবে।
খুনি গ্রেপ্তারের খবর শুনে পলাশবাড়ী এলাকার শতাধিক মানুষ বৃহস্পতিবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত সদর থানা ঘেরাও করে রাখে। দুপুরে আসামীকে কোর্টে চালান দেয়ার সময় আসামীকে লক্ষ্য করে জুতা সেন্ডেলের ঢিল ছোড়ে। আর ফাসির দাবি জানায়।
এ সময় এলাকাবাসী মিজানুর ও বেলায়েত জানান, খুনি মোখলেছুরের বাড়ি কাঠালবাড়ি ইউনিয়নের শিবরাম গ্রামে। ঐ গ্রামের মৃত ফয়েজ উদ্দিনের ছেলে সে। প্রায় ২৫ বছর আগে বিয়ে সুত্রে পলাশবাড়ি পশ্চিমপাড়ায় শ্বশুর বাড়িতে ঘরজামাই হিসাবে বসবাস করে আসছিলো। মাথা গরম স্বভাবের ছেলে মোখলেছুরের নির্দিষ্ট কোন পেশা ছিলো না। রিক্সা চালানো,মুরগীর ব্যবসা, হোটেলে রান্নার কাজ, দিনমুজরীর কাজ, ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সাইডে থাকার কাজ করতো। কিন্তু স্থির ছিলোনা কোথাও। বেশিরভাগ সময় হাতে কাজ থাকতো না। তাই সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকতো। স্ত্রী সাহেরা সংসার চালানোর জন্য বাড়িতে দর্জির কাজ করতো। ছেলে শামীম করতো রাজমিস্ত্রীর কাজ। জুয়া, পরকীয়া, অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতায় বিরোধ লেগেই থাকতো। কিন্তু এর পরিনতি খুন হবে তা কেউ ভাবতে পারেনি।
মামলার বাদি ফাতেমা বেগম জানান, আমার জামাই আমার মেয়েকে হত্যা করে পালিয়ে গেছে। আমি সারাদিন বাইরে ছিলাম। খবর শুনে এসে মেয়ের গলাকাটা মরদেহ দেখতে পাই। আমি আমার মেয়ে হত্যার বিচার চাই। ফাসি চাই।
কুড়িগ্রামের পুলিশ সুপার আল আসাদ মো: মাহফুজুল ইসলাম জানান, খবর পেয়ে আমি নিজেই ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি। প্রাথমিক ভাবে জানাগেছে পারিবারিক কলহের কারনে এ হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটেছে। আসামীকে পুলিশ অল্প সময়ের মধ্যে গ্রেপ্তার করতে সÿম হয়েছে। তদন্ত্ম চলছে। এর বাইরেও যদি কেউ এ ঘটনার সাথে জড়িত থাকে তাদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।
যে ভাবে খুন করে পালিয়ে যায় ঘাতক
স্ত্রী খুনের দায়ে অভিযুক্ত মোখলেছুর রহমান অনুতপ্ত দাবি করলেও তার চেহারায় চোখে মুখে ছিলোনা কোন মলিনতার লেশমাত্র। একেবারেই শান্ত ও স্বাভাবিক। বিৃহস্পতিবার দুপুরে কোর্টে চালান করবার সময় খুনির বিচারের দাবিতে বিক্ষোভকারীদের সরাতে পুলিশের বেগ পেতে হয়। এ সময় মোখলেছুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, আমার মাথা ঠিক ছিলো না। রিক্সা বিক্রির টাকার হিসাব নিয়ে ঝগড়া হয় স্ত্রী সাহেরা বেগমের সাথে। খারাপ ভাষায় গালিদেয়। প্রথমে গালে দুটা চর মেরেছি। বিছানায় পড়ে যায়। এরপর দা এনে গলায় কোপ দেই। গলগল করে রক্ত বের হয় তারপর সাড়াশব্দ ছিলো না। এ ঘটনার আগে সাউন্ডবক্সে বাজছিলো উচ্চ স্বরে গান। ফলে বাইরের কেউ বুঝতে পারেনি কি হচ্ছে। পরে বিছানায় লেপদিয়ে লাশ মুড়িয়েরেখে বাড়ির মুল দরজায় তালা ঝুলিয়েদেই। এরপর একটি অপরিচিত মটোরসাইকেলে চড়ে যাই বাসস্ট্যান্ডে সেখান থেকে রংপুর হয়ে দিনাজপুর জেলার নবাগঞ্জ থানা এলাকার টিকুর শালখুরিয়া গ্রামের পূর্ব পরিচিত এক বাড়িতে। পুলিশ সেখান থেকে আমাকে গ্রেপ্তার করে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *