নাজমুল হুদা পারভেজ (চিলমারী) কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি ঃ

‘ মোক একনা জমি আর ঘর যদি দিলে হয়, সারা জেবন মুই শেখের বেটি হাসিনার জন্যে দোয় করনু হয়”- কথা গুলি বলছিলেন ভূমিহীন ও গৃহহীন ষাটার্ধো মজিদা বেগম। তিনি আরও বলেন, মোর ধরা করার মানুষ নাই, কাঁই মোর কতা কইবে?

১৫ অক্টোবর সরেজমিনে ষাটার্ধো মজিদা বেগম এর সাথে কথা বলে জানা যায় তার জীবনের করুণ কাহিনি। ষাটার্ধো মজিদা বেগম জন্মসূত্রে ভূমিহীন ও গৃহহীন ছিল না। পুরাতন চিলমারী বন্দরের বালাজান গ্রামের মৃত সাবদুল মিঞার ছোট মেয়ে মজিদা বেগম। যখন সে ছোট ছিল যতদূর তার মনে পরে তার বাবা বড় একজন গৃহস্থ ছিলেন। অনেক জমা জমি ছিল তার। মজিদার বেড়ে ওঠার সাথে সাথে ব্রহ্মপুত্র নদীও তার বাবার সমস্ত সম্পত্তি ভেঙে নেয়। মজিদা যখন প্রাপ্ত যৌবনা ততদিনে ব্রহ্মপুত্র নদ সাত বার ভেঙে নিয়েছে তার বাড়ি -ঘর ।

অবশেষে পঞ্চম চিলমারী বন্দরে এসে ভূমিহীন ও গৃহহীন অবস্থায় দিনাতিপাত করতে থাকে তার গোটা পরিবার। এ সময় কন্যা দায়গ্রস্ত পিতা আরেক ভূমিহীন মৃত আব্দুর রহমান এর সাথে মজিদার বিয়ে দেয়। ১৭৮৭ ইং সালের ভূমিকম্পে ওলট-পালট হওয়া চিলমারী বন্দর জিতুরহাট নামক স্থানে তৃতীয়বারের মতো স্থাপিত হয়। সেই জিতুরহাটের চিলমারীতে নদীর ভাঙনে সবকিছু হারিয়ে মৃত আব্দুর রহমান একটি হোটেলে কারিগর হিসেবে কাজ শুরু করেছিল, জিতুর হাটের চিলমারী (তৃতীয় চিলমারী) ভেঙ্গে যাওয়ার মাত্র কিছু দিন পূর্বে। তখন তিনি বালক ছিলেন। নদী ভাঙনে ক্ষত বিক্ষত চিলমারী পঞ্চমবারের মতো গড়ে উঠেছিল দিয়ারখাতা চাকলীর পাড়া এলাকায় চিলমারী রেলওয়ে স্টেশনের সন্নিকটে।

সেখানে মৃত আব্দুর রহমান বিভিন্ন হোটেলে মিষ্টির কারিগর হিসেবে কাজ করতেন। তখন তিনি যুবক। বিয়ে করেন উক্ত মজিদা বেগমকে । মজিদা বেগম (৬৫) জানান, তখনও আমরা ভূমিহীন ছিলাম। যুদ্ধের বছর পঞ্চম চিলমারীও নদী ভাঙনের শিকার হলে তারা স্ব পরিবারে রমনা ব্যাপারী পাড়া এলাকায় মজিদার বেগমের এক ভাইয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেন। যুদ্ধের পর মজিদার স্বামী আব্দুর রহমান মারা গেলে তিনি দু মেয়েকে নিয়ে দিশেহারা হয়ে পরেন। স্বামী আব্দুর রহমান জীবিত থাকা অবস্থায় স্ত্রী মজিদাকে নই, মিষ্টি, জিলাপি, পিঁয়াজি সহ বেশ কিছু মিষ্টান্ন দ্রব্য তৈরি করতে শিখিয়েছিল। জীবন বাঁচাতে মজিদা তার স্বামীর শিখিয়ে দেয়া পথ ধরেই গুড় দিয়ে নই, জিলাপি, মিষ্টি ইত্যাদি তৈরি করে তার বড় মেয়ে আনারকলিকে দিয়ে জোড়গাছ হাটে পাঠাতেন বিক্রি করতে।

বিক্রি করে যে টাকা হাতে আসতো সেই টাকায় আবার পরের দিনের বিক্রির জন্য খাদ্যপন্য তৈরির কাঁচা মাল ক্রয় এবং করে বিক্রি করে লাভের সামান্য টাকায় চাল,ডাল কিনে আনতো মেয়ে আনারকলি। খেয়ে না খেয়ে কোনোমতে তিনি তার সংসার চালাতেন। এক সময় আনারকলি বড় হলে তার বিয়ে হয়ে যায়।্

এদিকে ভাইয়ের স্ত্রীর কারণে ভাইয়ের ভিটে মাটিতে মজিদার আর থাকা হয় না। আশ্রয়হীনা মজিদা ছোট মেয়েকে নিয়ে কোথায় যাবেন ? কি করবেন ভেবে না পেয়ে রমনা ইউনিয়নের নন্দির মোড়ে ওয়াপদা বাধের খাস জমিতে এ্কটি গভীর খালে মাটি কেটে ভরাট করে সেখানে সন্তানদেরকে নিয়ে থাকার একটা ব্য্রবস্থা করেন। বড় মেয়ের বিয়ের পর ছোট মেয়ে নুরিমা বেগম বড় বোনের মতো হাটে গিয়ে মায়ের হাতের তৈরি নই, পিয়াঁজী, জিলাপি বিক্রি করতে শুরু করে। এক পর্যায়ে সে বড় হয় এবং প্রেম করে বিয়ে করে। তার ঘরেই তিন সন্তানের জন্ম হয়। ১৪ বৎসর পূর্বে হঠাৎ নুরিমা বেগমের স্বামী মারা গেলে। আবার সব এলোমেলো হয়ে যায়। সংসারের করুণ অবস্থা ও দারিদ্রতা দেখে নুরিমা বেগমের বড় ছেলে নাহিদ হাসান ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা না দিয়েই ঢাকায় গিয়ে গার্মেন্টস এ চাকুরি নেয় । বর্তমানে মা- ছেলের কষ্টের উপার্জিত টাকায় চলছে তাদের সংসার। । সুতরাং এই পরিবারটি শুরু থেকেই ভূমিহীন। আর গৃহ বলতে যা বুঝায় সেটা একটি চালা ঘর।

মজিদা বেগমের করুণ আকুতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বর্তমানে ভূমি হীনদেরকে খাস জমিতে গৃহ বানিয়ে দিচ্ছে। তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট এক খন্ড মাটিসহ একটি ঘরের আবেদন জানিয়েছেন, যাতে তার নাতি- নাতনি ও মেয়েকে নিয়ে বাকি জীবনটা একটা স্থায়ী ঠিকানায় থেকে মরে যেতে পারেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *