@@@অবতার মহাপ্রভু৥৥
আজ থেকে বাংলা ও ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সনাতন ধর্মালম্বীদের বড় উৎসব শারদীয় দূর্গাপুজা। সনাতন ধর্মে দূর্গারপুজার ইতিহাস সম্পর্কে
বিভিন্ন ধর্ম গ্রন্থ পাঠে জানা যায়
দ্বাপর যুগের শেষের দিকে যখন কলি মাত্র গর্ভারেণু তখনকার কথা: শ্রী শ্রী চন্ডী ও দেবী মাহাত্ম্যম (মার্কণ্ডেয় পুরাণ) মতে সুরথ নামে এক ধর্ম পরায়ণ, নিষ্ঠাবান, প্রজা প্রেয়সী, বীরযোদ্ধা, মহাত্মা ও আত্মজ্ঞানী রাজা ছিল। সুরথ রাজা জন্মগত ক্ষত্রিয় ছিল এবং তাঁর জীবনের কোন যুদ্ধে পরাজয় হয়নাই। সুরথ রাজার রাজ্যের মধ্যে সুখ ও সমৃদ্ধি পরিপূর্ণরুপে ভরপুর। সুরথ রাজা রাজ্যের মঙ্গলের জন্য প্রায় সময় যজ্ঞের আয়োজন করত। কিন্তু সুরথ রাজার রাজ্যের পাশে যবন জাতি রাজ্য নামে এক রাজ্য ছিল, যে রাজ্য সুরথ রাজার রাজ্যের সাথে হিংসাত্মক আচরণ করতো।

একদিন যবন রাজ্য সুরথ রাজার রাজ্যের সাথে যুদ্ধ ঘোষণা করলো, তা শুনে সুরথ রাজা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি শুরু করলো। তারপর মাঘী পূর্ণিমার তৃতীয়াতে যুদ্ধের দিন ধার্য করা হলো এবং যথাক্রমে পূর্ণিমার তৃতীয়াতে যুদ্ধ শুরু হয়। কিন্তু যুদ্ধে যবন জাতির হাতে তাঁর পরাজয় ঘটে। সেই সুযোগে তাঁর মন্ত্রী ও সভা সদস্যরা তাঁর ধনসম্পদ ও সেনাবাহিনীর দখল নেন। সুরথ রাজা তাঁর রাজ্য সভার সদস্যদের এই কৃত্যকলাপ দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন, তিনি চিন্তা করলেন ঘর শত্রুর থেকে যবন জাতি অনেক ভাল ছিল অন্তত পক্ষে সামনে এসে আক্রমণ করেছে সুযোগের সদ্ব্যবহার তো করেনি। তখন সুরথ রাজা মনের দুঃখে বনে চলে আসেন, কারণ যুদ্ধে তিনি পরাজিত এবং রাজ্য দুষ্কৃতী কারীদেরহাতে দায়বদ্ধ, যদি সে রাজ্য ফিরে যায় তাহলে তাঁকে হত্যা করা হবে। বনের মধ্যে ঘুরতে ঘুরতে তিনি মেধা নামে এক ঋষির আশ্রমে এসে উপস্থিত হন। মেধা রাজাকে সমাদর করে নিজের আশ্রমে আশ্রয় দেন। কিন্তু বনে থেকেও রাজার মনে সুখ ছিল না। সব সময় তিনি তাঁর হারানো রাজ্যের ভালমন্দের কথা ভেবে শঙ্কিত হতেন।
এমন সময় একদিন বনের মধ্যে সুরথ সমাধি নামে এক বৈশ্যের দেখা পেলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে সুরথ জানতে পারলেন, সমাধির স্ত্রী ও ছেলেরা তাঁর সব টাকাপয়সা ও বিষয়সম্পত্তি কেড়ে নিয়ে তাঁকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু তাও তিনি সব সময় নিজের স্ত্রী ও ছেলদের কল্যাণ-অকল্যাণের কথা চিন্তা করে শঙ্কিত হন। তাঁদের মনে প্রশ্ন জাগল, যারা তাঁদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে, তাদের প্রতি তাঁদের রাগ হচ্ছে না কেন? কেনই বা তাঁরা সেই সব লোকেদের ভালমন্দের কথা চিন্তা করে করে শঙ্কিত হচ্ছেন? দুজনে মেধা ঋষিকে এই কথা জিজ্ঞাসা করলেন, ঋষি বললেন, পরমেশ্বরী মহামায়ার প্রভাবেই এমনটা হচ্ছে। সুরথ তাঁকে মহামায়ার কথা জিজ্ঞাসা করলে, তিনি একে একে তাঁকে তিনটি গল্প বলেন (এই গল্প গুলিই হলো শ্রীশ্রীচণ্ডী-রমূল আলোচ্য বিষয়)।
মেধার গল্প শুনে সুরথ ও সমাধি নদীর তীরে তিন বছর কঠিন তপস্যা করলেন। তপস্যায় প্রসন্ন হয়ে মহামায়া আবির্ভূত হইলেন, দেবী বললেন পুত্র তোমাদের তপস্যায় আমি প্রসন্ন বলো কি বর চাও? কিন্তু সুরথ ও সমাধি বর না চেয়ে তাঁরা দুজনে তাদের মনের গ্লানি মহামায়ার সামনে তুলে ধরলেন। তখন দেবী মহামায়া তাদের মুখবাণী শুনে সুরথ রাজাকেতাঁর হারানো রাজ্য ফিরিয়ে দিলেন এবং বৈশ্য সমাধিকে তত্ত্বজ্ঞান দিলেন। বৈশ্য সমাধি তত্ত্বাজ্ঞান পেয়ে নিজ জীবনযাত্রায় ফিরে যায়। কিন্তু সুরথ রাজা রাজ্য ফিরে পেয়েও নিজের মনের তৃপ্তি অপূর্ণ মনে হচ্ছিল। তখন সুরথ রাজা আবার বনে এসে মেধা মুনির আশ্রমে মুনির সাথে দেখা করলেন, তিনি নিজের অতৃপ্তির কথা মেধা মুনির সামনে উপস্থাপনকরলেন। রাজার কথা শুনে, মেধা মুনি সুরথকে মহামায়ার পূজা করার পরামর্শ দিলেন। তখন সুরথ রাজা মনস্থির করলেন, যে দেবীর কল্যাণে তিনি রাজ্যভার ফিরে পেয়েছেন তিনি সেই মহামায়ার পূজা করবেন এবং সৃষ্টিকে মায়ের কৃপান্নিত করবেন। তখন সুরথ রাজা মেধা মুনিকে জিজ্ঞাসা করলেন কখন মায়ের পূজা করবেন? মেধা মুনি বললেন চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষে ষষ্ঠী তিথিতে মায়ের বোধনেই পূজা আরম্ভ হবে। রাজা মুনিকে জিজ্ঞাসা করলেন পূজার প্রচলন কিরকম হবে? তখন মেধা মুনি বললেন, শাস্ত্রীয় মতে: দুর্গাষষ্ঠী, বোধন, আমন্ত্রণ ও অধিবাস।মহাসপ্তমী, নবপত্রিকা প্রবেশ ও স্থাপন, সপ্তম্যাদিকল্পারম্ভ, সপ্তমীবিহিত পূজা। মহাষ্টমী: মহাষ্টম্যাদিকল্পারম্ভ, কেবল মহাষ্টমীকল্পারম্ভ, মহাষ্টমীবিহিত পূজা, বীরাষ্টমী ব্রত, মহাষ্টমী ব্রতোপবাস, কুমারী পূজা, অর্ধরাত্রবিহিত পূজা, মহাপূজা ও মহোৎসবযাত্রা, সন্ধিপূজা। মহানবমী: কেবল মহানবমীকল্পারম্ভ, মহানবমী বিহিত পূজা।
বিজয়াদশমী: বিজয়াদশমী বিহিত বিসর্জনাঙ্গ পূজা, বিসর্জন, বিজয়াদশমী কৃত্য ও কুলাচারানুসারে বিসর্জনান্তে অপরাজিতা পূজা। সব নিয়মাবলী জানার পর চৈত্র মাসের শুক্ল পক্ষের ষষ্ঠী তিথিতে মেধা মুনির আশ্রমে সুরথ রাজা প্রথম দূর্গা পূজার প্রচলন শুভারম্ভ করে। তারপরের বছর হতে সুরথ রাজা দূর্গা পূজা নিজ রাজ প্রাসাদে করে। কিন্তু অত্র পূজায় তিনি মহাষ্টমীর সন্ধিপুজোর পর বলির প্রথা আরম্ভ করে। এভাবে সুরথ রাজা শতবর্ষে দূর্গা পূজায় একলক্ষ পাঁঠাবলি দেয়। এরকিছু বছর পর সুরথ রাজা দেহত্যাগ করে। দেহত্যাগের পরে রাজা স্বর্গে যাচ্ছিল, এমন সময় তিনি দেখলেন স্বর্গের দ্বারে লক্ষ লোক খর্ব হাতে নিয়ে দাড়িয়ে আছে। সুরথ রাজাকে দেখে ঐ লক্ষ লোক খর্ব হাতে নিয়ে রাজাকে তাড়া করে। এই দেখে রাজা দৌড়াচ্ছে আর দৌড়াতে দৌড়াতে রাজা কৈলাসে গিয়ে উপস্থিত। রাজাকে দেখে দেবী মহামায়া ও মহাদেব বললেন, কি হয়েছে তুমি দৌড়াচ্ছ কেন? রাজা বলেন মাতা, আমি মত্যলোকে আপনার পূজায় যে বলি প্রদান করেছি এখন তাঁরা সবাই মিলে খর্ব হাতে নিয়ে আমাকে বলি করার জন্য দৌড়াচ্ছে। তখন দেবী মহামায়া বললেন, পুত্র মেধা মুনি তোমার মনের গ্লানি দূরীকরণের জন্য আমার পূজা করতে বলেছিলেন কিন্তু সন্ধিপুজোয় বলি দিতে তো বলেননি। রাজা বললেন মাতা, আমি আপনাকে আরও বেশি প্রসন্ন করার জন্য বলি প্রদান করেছি। দেবী মহামায়া বললেন, পুত্র সৃষ্টি আমার আর সৃষ্টির প্রত্যেকটি জীব ও তথা মানব আমার পুত্র। আজ পর্যন্ত শুনেছ মায়ের সন্তানকে মায়ের কাছে বলি দিয়ে কেউ মাতৃকৃপা পেয়েছে। সব শুনে এবং নিজের ভুল বুঝে সুরথ রাজা বললেন, মা আমাকে ক্ষমা প্রদান করুন।
দেবী মহামায়া বলেন, পুত্র তোমাকে ক্ষমা করার মতো অধিকার আমার নেই ঐ লক্ষ পাঁঠাই তোমাকে ক্ষমা প্রদান করতে পারবে। সুরথ রাজা মহামায়াকে বলেন, মা এখন আমি কি করবো? মহামায়া বলেন তুমি অতিসীগ্র বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুদেবের সান্নিধ্যে যাও তিনিই তোমাকে উদ্ধার করতে পারবে। অতঃপর রাজা বৈকুণ্ঠে প্রস্থান করলেন, তিনি বৈকুণ্ঠে বিষ্ণুদেবের কাছে গিয়ে বললেন, প্রভু আমাকে রক্ষা করুন। বিষ্ণুদেব বললেন, বৎস তুমি পূর্ণ মহাত্মা কিন্তু তোমার ঐ একটি পাপ খন্ডন করতে হলে তোমাকে বলি হতে হবে? তখন রাজা বললেন, প্রভু যদি বলিতেই আমার উদ্ধার হয় তবে তাই হোক। অতঃপর লক্ষ পাঁঠা এসে বৈকুণ্ঠে হাজির। তখন লক্ষ পাঁঠা বিষ্ণুদেবকে বললেন প্রভু আমরা সুরথ রাজাকে বলিকরতে এসেছি। তখন বিষ্ণুদেব বললেন, দেখ তোমরা লক্ষ জন কিন্তু রাঁজা এক আর লক্ষ জন লক্ষ বার তো বলি করতে পারবে না?তখন পাঁঠারা বললেন, তাহলে প্রভু আমরা কি করব? বিষ্ণুদেব বললেন, তোমরা লক্ষ খর্ব এককরে সবাই ঐ খর্ব একত্রে হাতে নিয়ে রাজাকে বলি কর। তখন বিষ্ণুদেবের কথা মতো লক্ষ পাঁঠা লক্ষ খর্ব একত্রিত করে সবাই এক হাতে নিয়ে সুরথ রাজাকে ঐখানে বলিকরে। অতঃপর সুরথ রাজা ঐখানেই উদ্ধার হয়ে স্বর্গে যায়। সেইদিনের পর থেকে দূর্গা পূজায় বলি বন্ধ হয়ে যায়।(শাস্ত্র ও গ্রন্থ মতে দূর্গা পূজা পৃথিবীর আগে কোথায় হয়েছে তার কিছু বর্ণনা উপস্থাপন করছি)
দেবীভাগবত পুরাণ মতে: ব্রহ্মার মানসপুত্র ও সূর্যদেব পুত্র মনু (শ্লোক ৬) পৃথিবীর শাসক হয়ে ক্ষীরোদ সাগরের তীরে দুর্গার মাটির মূর্তি তৈরি করে পূজা করেন। এই সময় তিনি “বাগ্ভব” বীজ জপ করতেন এবং আহার ও শ্বাস গ্রহণ ত্যাগ করে এক পায়ে দাঁড়িয়ে একশো বছর ধরে ঘোর তপস্যা করেন। এর ফলে তিনি শীর্ণ হয়ে পড়লেও, কাম ও ক্রোধ জয় করতে সক্ষম হনএবং দুর্গানাম চিন্তা করতে করতে সমাধির প্রভাবে স্থাবরে পরিণত হন। তখন দুর্গা প্রীত হয়ে তাঁকে বর দিতে আসেন। মনু তখন দেবতাদেরও দুর্লভ একটি বর চাইলেন। দুর্গা সেই প্রার্থনা রক্ষা করেন। সেই সঙ্গে দুর্গা তাঁর পথ নিষ্কণ্টক করেন এবং মনুকে পুত্রলাভের বরও প্রদান করেন (শ্লোক ৭)। 卐 ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণের মতে: সৃষ্টির প্রথম যুগে পরমাত্মা বিষ্ণু বৈকুণ্ঠের আদি-বৃন্দাবনের মহারাসমণ্ডলে প্রথম দুর্গাপূজা করেন। 卐 এরপর মধু ও কৈটভ নামে দুই অসুরের ভয়ে ব্রহ্মা দ্বিতীয়দুর্গাপূজা করেছিলেন। 卐 ত্রিপুর নামে এক অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ করতে গিয়ে শিব বিপদে পড়ে তৃতীয় দুর্গাপূজার আয়োজন করেন। 卐 দুর্বাসা মুনির অভিশাপে লক্ষ্মীকে ( অর্থাৎ শ্রী হীন অবিশাপ ) হারিয়ে ইন্দ্র যে পূজার আয়োজন করেছিলেন, সেটি ছিল চতুর্থ দুর্গাপূজা।

卐 দূর্গা ও দুর্গাপূজাকে কেন্দ্র করে যতগুলি পৌরাণিক কথাপ্রচলিত আছে, তার মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় কথা পাওয়া যায় শ্রী শ্রী চণ্ডী বা দেবীমাহাত্ম্যম্-এ। এই কথাগুলো হিন্দুরা এতটাই মান্য করে যে, শ্রী শ্রী চণ্ডীর পাঠ দুর্গাপূজার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে গিয়েছে। দেবীমাহাত্ম্যম্আসলে মার্কণ্ডেয় পুরাণ-এর একটি নির্বাচিত অংশ। এতে তেরোটি অধ্যায়ে মোট সাতশোটি শ্লোক আছে। এই পুরাণে দুর্গাকে নিয়ে প্রচলিত তিনটি কথা ও দুর্গাপূজা প্রচলনের একটি নিয়মাবলী রয়েছে। তার মধ্যে সুরথ রাজার কথাটি প্রত্যক্ষ কেননা এটি এই পৃথিবীর মধ্যে প্রথম এবং বিদ্যমান সাক্ষী।বিঃদ্রঃ :- এই পৃথিবীর মাটিতে যে প্রথম দূর্গা পূজা হয়েছিল সেই মেধা মুনির আশ্রম বর্তমানে বোয়ালখালীর ভূষী গ্রামের করলডেঙ্গা পাহাড়ের উপর অবস্থিত। এজন্য কলিযুগের শুরুতে এই আশ্রমকে প্রথম তীর্থস্থান বলে ঘোষিত করা হয়।
-লেখক,সাংবাদিক,বিভিন্ন ধর্ম ও বাউল গবেষক-

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *