তাজিদুল ইসলাম লাল, রংপুর

আভ্যান্তরীন দ্বন্দ্ব, অধ্যক্ষের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ ও শিক্ষক কর্মচারী দীর্ঘদিনেও বেতন-ভাতাদি না হওয়ার কারণে শিক্ষা ব্যবস্থায় বেহাল দশায় পরিণত হয়েছে বড়াইবাড়ী কলেজে। এ কারণে এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় কেউই পাশ করেনি। এ ঘটনায় এলাকায় হাস্যরসে পরিণত হয়েছে এবং অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। এদিকে, কি কারণে এ পরিণতি জানতে চেয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছেন উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা।
কলেজ সুত্রে জানা গেছে, এবারের দিনাজপুর শিক্ষা বোর্ডের অর্ধীনে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বড়াইবাড়ী কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগের ৩জন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। তাদের মধ্যে কেউই পাশ করেনি। সরেজমিনে গতকাল সোমবার বিকাল ৩টায় কলেজে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। এসময় স্থানীয়রা জানান, কলেজটিতে বেতন ভাতাদি বন্ধ থাকায় শিক্ষক কর্মচারী কেউ আসেনা। ভর্তি ও ফরম ফিলাপের সময় অধ্যক্ষসহ দুএকজন দেখা যায়। তবে স্থানীয় শিক্ষক, কেরানী বা অন্যান্য কর্মচারী কলেজের বিষয়ে কোন তথ্যই জানেন না। বিভিন্ন সময় ভর্তি, টেষ্ট পরীক্ষাসহ সার্বিক বিষয়ে সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন অধ্যক্ষ সিরাজুল ইসলাম। তার সাথে মুঠোফোনে অসংখ্যবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি ফোন রিসিফ করেননি। পরে খুদে বার্তা পাঠানো হলেও কোন জবাব দেননি।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, ম্যানেজিং কমিটি, অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের মধ্যে অভ্যান্তরীন দ্বন্ধ দীর্ঘ দিনের। কলেজটি ২০০২ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ২০০৯ সালে স্বীকৃতি লাভ করে। ২০১৭ সালে অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি শুধুমাত্র ফরম ফিলাপের সময় কলেজে আসেন। কারও ফোন রিসিভ করেন। রংপুরের বাসা থেকে কলেজ পরিচালনা করেন। গঙ্গাচড়ার বড়াইবাড়ী, নোহালী, আলমবিদিতর, বড়বিল ও কোলকোন্দ ইউপির বৃহত্তর এলাকার প্রান্তিক জনগোষ্টি মানুষের সন্তানেরা মাধ্যমিক পেরিয়ে উচ্চ মাধ্যমিকের জন্য একটি মাত্র কলেজ তা হচ্ছে বড়াইবাড়ি কলেজ।
সুত্র মতে, কলেজটি প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে নামকরণ হয়েছিল মুক্তিযোদ্ধা আদর্শ মহাবিদ্যালয়। এরপর বিএনপি জামায়াত ক্ষমতায় আসলে জমির দলিল পরিবর্তন না করে এর নামকরণ হয় শহীদ জিয়ার রহমান কলেজ। একাধিকবার নাম পরিবর্তন ও ম্যানেজিং কমিটির দ্বন্দ্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসীরা কলেজটির নেতৃত্ব থেকে সরে আসেন। নানান সমস্যায় দীর্ঘ ১৮ বছরেও কলেজটি এমপিওভুক্ত কিংবা শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন হয়নি।
বোর্ড সুত্রে জানা গেছে, এ বছর নয়টি সাধারণ শিক্ষাবোর্ড, মাদ্রসা ও কারিগরি বোর্ড মিলে গড় পাশের হার ৯৫ দশমিক ২৬ শতাংশ। পরীক্ষায় পরীক্ষার্থী ছিল ১৪ লাখ ৩ হাজার ২৮৮ জন। এর মধ্যে অংশগ্রহণ করে ১৩ লাখ ৭১ হাজার ৬৮১ জন, যার ১৩ লাখ ৬ হাজার ৭১৮ জন উত্তীর্ণ হয়েছে। এ পরীক্ষায় ৯ হাজার ১১১টি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশ গ্রহণ করে। যার মধ্যে ৫টি প্রতিষ্ঠানের কোনো শিক্ষার্থী উর্ত্তীণ হতে পারেনি। তার মধ্যে রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার বড়াইবাড়ী কলেজ ও ঠাকুরগাঁও জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার পীরগঞ্জ কলেজিয়েট স্কুল এ্যান্ড কলেজ। রংপুর বিভাগের ৮ জেলায় ৬৬৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা মোট ২০৩টি কেন্দ্রের মাধ্যমে পরীক্ষায় অংশ গ্রহণ করেন। এবারে পরীক্ষায় বহিষ্কৃত হয়েছে ৩ জন শিক্ষার্থী। শতভাগ পাশকৃত কলেজের সংখ্যা ৫৩টি, ১০ থেকে ৫০ শতাংশ পাশের সংখ্যা ১০টি কলেজ এবং ৫০ থেকে ৯৯ শতাংশ পাশের সংখ্যা ৬০২টি।
দ্বাদশ শ্রেণীর মানবিক বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র শিমুল জানান, দেড় বছরেও কোন দিন অধ্যক্ষকে কলেজে দেখিনি। আমাদের ক্লাসও হয়না। কেউ খোঁজও নেয় না।
কলেজের দর্শন প্রভাষক শাফিয়া ইয়াসমিন জানান, ২০১৩ সালে শূন্য পদে নিয়োগ হওয়ার কলেজটিতে লেখাপড়ার মান ভালোয় ছিল। তবে ২০১৬ মুকুল নামে অধ্যক্ষের বদলি হয়। এরপর অধ্যক্ষ হিসেবে যোগদান করেন সিরাজুল ইসলাম। তিনি যোগদানের পর থেকে কলেজে না এসে রংপুরের শহরের বাসা থেকে কলেজ পরিচালনা করেন। এতে করে শুরু হয়ে যায় অধ্যক্ষ ও শিক্ষকদের মধ্যে দ্বন্ধ। এমনিতেই বেতন নেই। তিনি আরও বলেন, লোকাল শিক্ষক হিসেবে আমি কলেজে গেলে কাউকে পাই না। অধ্যক্ষ কলেজে না আসার কারণে অন্যান্য শিক্ষক কর্মচারীরা ঠিকমত কলেজে আসে না। তাছাড়া গত দুই বছর থেকে করোনা ভাইরাস। নানান সমস্যা থাকায় ঠিকমত ক্লাস হয়নি বা টেষ্ট পরীক্ষাও হয়নি।
কলেজ সভাপতি নুর ইসলাম লাভলুু জানান, ১৮ বছর থেকে শিক্ষক কর্মচারীরা বেতন ভাতাদি পায় না। এ কারণে সঠিকভাবে লেখাপড়া হয় না। এছাড়াও গত দু বছরে করোনার কারণেও শিক্ষা ব্যবস্থায় ধ্বস নেমে এসেছে। আমাদের গ্রামের ছেলে মেয়েরা অনলাইন ক্লাস বোঝে না। এসবসহ নানান কারণে কেউ পাশ করেনি। তাছাড়া কলেজটি প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরে অনেক শিক্ষক কর্মচারী ৩ থেকে ৫ লাখ টাকা দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। দীর্ঘ দিন থেকে বেতন না পাওয়ায় তারা হতাশ। তিনি জানান, আমি ৩ মাস আগে সভাপাতি মনোনীত হয়েছি। খুব কঠোরভাবে এবার কলেজ পরিচালনা করবো।
বড়াইবাড়ী এলাকার কৃতি সন্তান বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য রবিউল ইসলাম রেজভি বলেন, নানান সমস্যা থাকায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাসীরা কলেজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়। এ কারণে দীর্ঘদিনেও কলেজটি এমপিওভুক্ত হয়নি। বর্তমানে কলেজটি নানান সমস্যায় জর্জরিত। এ কারণে লেখাপড়ার মান ভালো হয়না।
গঙ্গাচড়া মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা শাহনাজ বেগম জানান, দীর্ঘ ১৮ বছর থেকে কলেজটির বেহাল দশা। এবারের এইচএসসি পরীক্ষায় ৩জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করেছিলেন এর মধ্যে কেউ পাশ করেনি। এই করুণ পরিণতির বিষয়ে ব্যাখ্যা চেয়ে কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে নোটিশ পাঠিয়েছি। # ১৪-২-২২

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *