এস.এম.রকিঃ
স্বাধীনতার সূর্বণজয়ন্তীতে সকলকে স্বাধীনতা দিবস ও জাতীয় দিবসের শুভেচ্ছা জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের লোমহর্ষক কাহিনি বলতে গিয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে স্বাধীনতা পদক প্রাপ্ত বীর মুক্তিযোদ্ধা অধ্যাপক ডা.এম আমজাদ হোসেন বলেন, যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনারা তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে মুক্তিযোদ্ধাদের। ওই অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে নষ্ট হলো নিজের এলএমজি। গুলিবিদ্ধ হলেন দুই পায়ে, ভেঙে গেল এক পা। পড়ে গেলেন ধানখেতে। ধরে নেন ওই দিনই জীবনের শেষ দিন। কিন্তু এক সহযোদ্ধা নিজের জীবনের বিনিময়ে রক্ষা করে যান তাঁদের। তাই সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত জীবনের প্রতিটি দিনই বোনাস।

অধ্যাপক আমজাদ হোসেন দেশবরেণ্য অর্থোপেডিক সার্জন। স্বাধীনতার সূবর্ণ জয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকীতে গৌরব ও মর্যাদাপূর্ণ রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ পুরস্কার “স্বাধীনতা পদক” প্রাপ্ত গুণী এই চিকিৎসক ১৯৫৩ সালের ৫ই জুলাই উত্তরের জেলা দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার দক্ষিণ সুখদেবপুর গ্রামের এক সাধারণ কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম মরহুম আব্দুল বাকী মন্ডল এবং মাতার নাম আলহাজ্ব আমেনা খাতুন। দুই সন্তানের জনক অধ্যাপক ডা.আমজাদ হোসেন ও ডা.শামীমা আমজাদ দম্পতির বড় ছেলে আজমত হোসেন (সৈকত) ইংল্যান্ডের এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার’স এন্ড বিজনেস ম্যানেজমেন্ট বিষয়ে পড়াশুনা করছেন ও মেয়ে আফিয়া তাসনিম (শর্মী) ওয়াশিংটনের ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে কর্মরত। অধ্যাপক ডা.এম আমজাদ হোসেন ১৯৬৮ সালে চিরিরবন্দর উচ্চ বিদ্যালয় হতে মাধ্যমিক ও ১৯৭০ সালে দিনাজপুর সরকারী কলেজ হতে উচ্চ মাধ্যমিক পাস করেন। ছাত্র অবস্থা থেকেই বঙ্গবন্ধুর আর্দশের অনুসারী তিনি ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি স্বইচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে তৎকালীন দিনাজপুরের কামারপাড়া, রায়গঞ্জ ও সিলিগুড়ি ক্যাম্পে উচ্চতর প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত হয়ে ৭নং সেক্টরের অধীনে টিম লিডার হিসেবে সরাসরি দিনাজপুর বড় গ্রাম, নিউটাউন ও রুদরানীসহ বিভিন্ন পাকিস্তানি ক্যাম্প ও স্থাপনার উপরে গেরিলা আক্রমণ করেন। অতঃপর ১৯৭১ সালের ৩১ জুলাই ফুলবাড়ী ভেড়াম গ্রামে এক গেরিলা যুদ্ধে শত্রু সেনাদের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধে দু’পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে গুরুতর আহত হন এবং তাঁর সহযোদ্ধা বীর মুক্তিযোদ্ধা মোজাফফর হোসেন শহীদ হন। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় রক্তাক্ত আমজাদ হোসেনকে বালুরঘাট সরকারী হাসপাতাল এবং লক্ষ্মৌ ও বিহারের রামগড় সামরিক হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠেন। এরপরে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আমজাদ হোসেন ১৯৭৮ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করেন ও ১৯৮৬ সালে অর্থোপেডিক বিষয়ে এম এস ডিগ্রি অর্জন করেন। চিকিৎসার সুবাদেই দেখা হয় আমেরিকান চিকিৎসক ডা.আর জে গাষ্টের সাথে। ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাশ করে চিকিৎসক হয়ে ডা. গাষ্টের আহবানে সরকারি কাজের পাশাপাশি অবৈতনিক ভাবে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা কল্যান ট্রাষ্টে দায়িত্ব পালন করেন।

এমবিবিএস ডিগ্রি লাভ করে পার্বতীপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মেডিকেল অফিসার হিসাবে কাজ করেন এরপরে তিনি সহকারী, সহযোগী ও অধ্যাপক হিসেবে নিটর, সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল এবং ঢাকা মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ২০০৮ সালে চাকুরী হতে স্বেচ্ছায় অবসর নিয়ে ল্যাবএইড স্পেশালাইড হাসপাতালে অর্থোপেডিক সার্জারী বিভাগে চীফ কনসালটেন্ট হিসেবে কাজ করে যাচ্ছেন। অর্থোপেডিক সার্জারী চিকিৎসায় তিনি বাংলাদেশে বৈপ্লবিক পরিবর্তন নিয়ে আসার অন্যতম কারিগর।

এবার শুরু করলেন রণাঙ্গনের সেই ভয়াবহ দিনের গল্প। আমজাদ হোসেন বলেন, ‘দিনটা ছিল একাত্তরের ৩১ জুলাই। ওই দিন রাতে আমার নেতৃত্বে দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ভেরাম গ্রামে হানাদার বাহিনীর ক্যাম্পে আমরা গেরিলা হামলা চালাই। কিন্তু রাজাকারেরা আমাদের অভিযানের খবর আগেভাগেই জানতে পেরে পাকিস্তানি আর্মিকে জানিয়ে দেয়। পাকিস্তানি আর্মি আমাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে। আমরা সামনে সাতজন আর পেছনে সাতজন। আর ওরা ছিল মোট ২৯ জন। সামনের সারিতে সবার ডানে ছিলেন মোজাফ্ফর নামে এক মুক্তিযোদ্ধা। আমার এলএমজি হঠাৎ বন্ধ হয়ে গেলে আমি দাঁড়িয়ে পেছনে ফেরার চেষ্টা করি। এ সময় আমার দুই ঊরুতে গুলি লাগে। একটি পা ভেঙে যায়। আমি ধানখেতে পড়ে যাই। মোজাফ্ফর যুদ্ধ চালিয়ে আমাদের কভার ফায়ার দিতে থাকেন আর আমাদের পিছু হটতে বলেন। এ সময় একটি গুলি মোজাফ্ফরের কপালে বিদ্ধ হয়। তিনি সেখানেই শহীদ হন। পেছন থেকে আরও মুক্তিযোদ্ধা এসে যোগ দিলে পাকিস্তানি সেনারা ধীরে ধীরে পিছু হটে। তারপর আমরা মোজাফ্ফরকে সীমান্তের কাছাকাছি এনে দাফন করি। সহযোদ্ধারা আমাকে সেখান থেকে বাঁশের খাটিয়ায় নদী পার করে সীমান্ত পেরিয়ে বালুরঘাট হাসপাতালে নিয়ে যায়।’

এক নিশ্বাসে গল্পটা বলে গেলেন আমজাদ হোসেন। এরপর একটু সময় নিয়ে বললেন, ‘সেদিন যুদ্ধের ময়দানে তো আমার বুকেও গুলি লাগতে পারত। তা লাগেনি। তাই সেদিনের পর থেকে প্রতিটি দিনই জীবনে বোনাস বলে ধরে নিয়েছি।’ তারপর থেকেই নিজের অবস্থান থেকে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। যার চিরিরবন্দর উপজেলায় আমেনা-বাকী রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজ তৈরী করেছি। যা শিক্ষা ক্ষেত্রে পরিবর্তন এনেছে। এতে শিক্ষা নগরী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চিরিরবন্দর। এর সাথে দেশ ও দশের প্রয়োজনে কাজ করার স্বীকৃতি হিসেবে ২০২১ সালে সমাজসেবায় স্বাধীনতা পদকে ভূষিত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এজন্য ওনার প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ।

অধ্যাপক ডা. এম আমজাদ হোসেন বলেন, বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে যেই স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধে গেছিলাম তা বাস্তবায়নে কাজ করছে বঙ্গবন্ধু কন্যা প্রিয় প্রধানমন্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভানেত্রী শেখ হাসিনা। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা ও শেখ হাসিনা’র আধুনিক ও উন্নত বাংলা বিনির্মাণে আমৃত্যু কাজ করে যেতে চাই। এই জন্য সকলের কাছে দোয়া, পরামর্শ ও সহযোগিতা কামান করছি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *