মোশাররফ হোসেন মুসা

যেদিন ৮ম পে-স্কেল ঘোষিত হয় সেদিন পত্রিকার দোকানে কোনো পত্রিকাই অবিক্রিত থাকেনি। শোনা গেছে, সমস্ত পত্রিকা চাকরিজীবিরা কিনে নিয়ে গেছেন। তারা অন্যদিন পত্রিকা না কিনলেও সেদিন কিনেছেন শুধুমাত্র কার কত বেতন বৃদ্ধি পেল, নতুন কি কি সুবিধা যোগ হলো ইত্যাদি খুটিনাটি বিষয়ে জানার জন্য ও পরস্পরের সঙ্গে আলোচনা করার জন্য। ঘোষিত পে-স্কেলে তাদের বেতন প্রায় দ্বিগুণ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। তাতেও তারা সন্তষ্ট নন। তারা বেতন স্কেল পরিবর্তন ও বেতন বৈষম্য দুর করা সহ নানা প্রকার দাবিতে আন্দোলন শুরু করেছেন। কোনো কোনো ক্যাডারের লোকেরা অবস্থান ধর্মঘট সহ দুই ঘন্টা করে কর্ম-বিরতি পালন করছেন। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাও অন্যান্য চাকরিজীবিদের মতো আন্দোলন শুরু করেছেন। তাঁরাও এখন সর্বোচ্চ গ্রেডের দাবিতে ক্লাস বর্জন ও মিছিল-মিটিং অব্যাহত রেখেছেন (যদিও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক বৈঠকের পর তাঁদের কর্মসূচী কিছুদিনের জন্য স্থগিত রেখেছেন)। আমরা জানি, একজন গার্মেন্টস শ্রমিকের মাত্র পাঁচ হাজার টাকা। কৃষকদের উৎপাদিত ফসলের মূল্য ও কৃষি উপকরণের দাম প্রায় সমান সমান। চাকরিজীবিদের কারো মুখে শোনা যায় নি- ‘আমাদের বেতন যথেষ্ঠ। এই মুহুর্তে বেতন বৃদ্ধির প্রয়োজন নেই। যাদের শ্রমে দেশ এগুচ্ছে তাদের ব্যবস্থা আগে হোক।’ বাস্তবে এর বিপরীতটাই দেখছি। সরকার কোথ্বেকে দেবে, অতিরিক্ত বেতনের ব্যয় ভার কারা বহন করবে এসব বিষয়ে তারা জানতে আগ্রহী নন। তাদের ‘চাওয়া’ নির্ভর মানসিকতা (খধনড়ৎ সবহঃধষরঃু) স্বাধীন দেশে এভাবে বিদ্যমান থাকা কতটা যৌক্তিক প্রশ্ন করা যেতে পারে। যেহেতু একটি স্বাধীন ও গণতান্ত্রিক দেশে কোনো শাসক থাকেন না, প্রজাও থাকে না। সেখানে সবাই মালিক সবাই কর্মী। স্বাধীনতার দীর্ঘ ৪১ বছর পরেও কেন যে আমরা উপনিবেশিক মনোবৃত্তি থেকে বেরুতে পারছি না এটাই এখন গবেষণার বিষয়।

গ্রীক দার্শনিক এ্যারিস্ট্যাটল বলেছেন-‘সব চাকরিই মনকে শুষে নেয় ও হীন করে তোলে।’ এ্যারিস্ট্যাটল দাস যুগের দার্শনিক ছিলেন। সে সময় দাসদের ও গৃহপালিত পশুদের একই চোখে দেখা হতো। তিনি চাকরিজীবি বলতে রাজ কর্মচারী ও সৈন্য-সামন্তদের বুঝিয়েছেন। তিনি মনে করতেন প্রত্যেক শাসকের দার্শনিক জ্ঞান থাকা আবশ্যক। সেজন্য তাদের অবসর ও স্বাধীনতা উভয়ই প্রয়োজন। বর্তমান যুগের চাকরিজীবিরা বেতনভুক্ত কর্মচারী হলেও পূর্বের মতো পরাধীন নয়। তারা প্রতি কর্ম দিবসে একটি নিদিষ্ট সময় পর্যন্ত জনগণের সেবায় নিয়োজিত থাকেন। তারা বিনা প্রশ্নে সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে নিয়োজিত থাকবেন-এমন শপথ নিয়েই চাকরিতে প্রবেশ করেন। তারা সরকারের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে মতামত দিতে পারেন না। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়গুলো স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান হওয়ায় শিক্ষকেরা যথেষ্ট স্বাধীনতা ভোগ করেন। সেখানে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দেওয়া আইন বিরোধী নয়। বহু শিক্ষক রয়েছেন যারা বিরোধী দলে অন্তর্ভুক্ত হয়ে রাজনীতিতে সক্রিয় রয়েছেন। সেজন্য তাদের আন্দোলন হওয়া উঠিত অভিভাবক সুলভ। তারা ক্লাস বর্জন ও মিছিল-মিটিং করে প্রমাণ করেছেন তাঁরা বেতনের মাপকাঠিতে নিজেদের মর্যাদা রক্ষা করতে চান। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রবীণ শিক্ষক ড. অজয় রায় বলেছেন- ‘শিক্ষকদের উচিত ছিল বারান্দায় কিংবা মাঠে ক্লাস নিয়ে প্রতিবাদ জানানো’। প্রধানমন্ত্রী যথার্থই বলেছেন-‘শিক্ষকেরা মহান পেশার মানুষ। তারা কেন নিজেদের আমলাদের সঙ্গে তুলনা করেন। তারা তো নিজেরাই নিজেদের কর্মে অনেক বড়। … … উনারা সচিবের সমান কেন মর্যাদা চান? সচিবদের সঙ্গে কি অধ্যাপকদের তুলনা চলে? কোনো সচিবকে কি অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের সঙ্গে তুলনা হয় (আ.অর্থনীতি, ৫ জানু’১৬)’। শিক্ষকদের বক্তব্য হলো- তাঁরা বেতন বৃদ্ধির জন্য আন্দোলন করছেন না। বর্তমান পে-স্কেলে গ্রেড অনুযায়ী মর্যাদা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। শিক্ষকদের সর্বোচ্চ ধাপ ‘প্রফেসর’ পদটি তৃতীয় গ্রেডে নামানো হয়েছে। কোনো কোনো শিক্ষক বলেছেন, তারা যদি কোনো কাজ না করে থাকেন তাহলে বিসিএস পাস প্রতিভাবানরা আসে কোথ্বেকে? সকলের জানা রয়েছে, এদেশে বড় বড় দূর্নীতির পিছনে তথাকথিত প্রতিভাবানদের সক্রিয় ভূমিকা থাকে। তারা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহু কিছু শিখলেও দেশপ্রেমের কোনো শিক্ষা পান নি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কাবেরী গায়েন ‘বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কাজ করেন না’ শীর্ষক এক কলামে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আনিত কিছু অভিযোগ খন্ডনের চেষ্টা করেছেন। অভিযোগগুলো হলো- তাঁরা ক্লাস নেন না, পড়ান না, নিজেরাও পড়েন না। ছাত্রদের শেখাবেন কি! তাঁদের কোনো গবেষণা নেই। পৃথিবীর ১০০টি কিংবা ১০০০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম নেই কেন ইত্যাদি (প্র.আলো, ১২ জানুয়ারি’১৬)। তিনি উপরিউক্ত অভিযোগগুলোর বিরুদ্ধে যতই যুক্তি দেখান না কেন, আমরা অভিযোগগুলোর পক্ষে বহু প্রমাণ দেখতে পাই। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পিছনে প্রতি বছর গড়ে প্রায় ২ লক্ষ টাকা ব্যয় হয় (যদি শিক্ষকদের বেতন, অবকাঠামো ব্যয়,গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানির বিল সহ অন্যান্য সিস্টেম কস্ট যোগ করা হয় তাহলে এই ব্যয় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা ছাত্র-ছাত্রীদের জুনিয়র স্কলার হিসেবে গণ্য করেন। কিন্তু তাঁরা যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাস পোড়ান, ক্লাস-রুম ভাংচুর করেন, সিট দখল করেন, কেন্টিনে ফাঁও খান ইত্যাদি দেখলে মনে হয় না তাদের মধ্যে মালিকানাবোধ (ঙহিবৎংযরঢ় সবহঃধষরঃু) আছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান, লোক প্রশাসন, সমাজ বিজ্ঞান থেকে পাশ করা বহু শিক্ষার্থী পাওয়া যাবে, যারা বিদ্যমান শাসন ব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক সরকার ব্যবস্থা, সরকারের আয়-ব্যয় ইত্যাদি বোঝেন না। তাদের একটাই লক্ষ্য থাকে- সার্টিফিকেট নাও, তদবির করে একটি সরকারি চাকরি বাগাও। অথচ স্বায়ত্বশাসনের পূর্ব শর্ত হলো অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বি থাকা। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে স্বাবলম্বি হওয়ার কথা বললে বহু বিজ্ঞ ব্যক্তি এর বিরুদ্ধে মতামত দেওয়া শুরু করেন। তাদের মতে- ‘সরকারের বহু প্রতিষ্ঠান আছে যাহা লাভজনক নয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরকারি ব্যয় বেশি হলেও এটিকে অপচয় হিসেবে গণ্য করা যাবে না।’ পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন, এলজিইডি সহ বহু প্রতিষ্ঠান রয়েছে যেখানে কর্মের বিপরীতে কর্মীর সংখ্যা বেশি। এদেশে বেসরকারিভাবে বহু স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণ করা হয়েছে শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে নয়, বেতন পাওয়ার উদ্দেশ্যে। একেকটি প্রতিষ্ঠান যেন বেকারদের কর্ম সংস্থানের জায়গা। আমরা পূর্বের মতো অর্থনীতিতে অস্বচ্ছল অবস্থায় নেই। নিম্ন আয়ের দেশ থেকে মধ্যম আয়ের দেশে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। বহু শিক্ষিত যুবক আছেন- যারা সরকারি চাকরির চেয়ে বেসরকারি চাকরিকেই বেশি পছন্দ করেন। তারা নতুন নতুন ব্যবসা সহ বহু শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। এমতাবস্থায় পরাধীন আমলের মনোবৃত্তি ধারণ করে চাকরি করা মোটেই উচিত হবে না। একজন বোদ্ধা পাঠক আক্ষেপ করে আমাকে বলেছেন- ‘দেশের সার্বিক দুরাবস্থা সমাধানকল্পে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে এমন কোনো গবেষণা পাওয়া যাবেনা, যা দিয়ে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করা যায়।’ আমাদের রাজনীতিকরাও কি ‘চাই-চাই’ মানসিকতা থেকে মুক্ত নন। জাতীয় সংসদের লবিতে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে এমপিদের মিছিল করার ঘটনাও লক্ষ্য করা গেছে। স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন আসে, তাঁরা যদি মিছিল করেন তাহলে সমাধানকারী কর্তৃপক্ষ (গধহধমবসবহঃ অঁঃযড়ৎরঃু) কারা? বর্তমান সরকার মন্ত্রী, স্পীকার ও এম.পিদের বেতন দ্বিগুণ ও অন্যান্য ভাতা তিনগুণ করার প্রস্তাব করেছেন। এটাও শতভাগ সত্য যে, রাজনীতিতে অসুস্থতা থাকলে সেই অসুস্থতা থেকে রাষ্ট্রের কোনো প্রতিষ্ঠানই মুক্ত থাকে না। সেই অসুস্থতা থেকে কিভাবে মুক্তি পাওয়া যাবে, কিভাবে সর্বক্ষেত্রে জনগণের মালিকানা প্রতিষ্ঠা করা যাবে, সর্বোপরি কিভাবে সকলের মনে মালিকানা বোধ জাগ্রত করা যাবে ইত্যাদি বিষয়ের দিশা দেখানোর দায়িত্বও বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর উপর বর্তায়। যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয় হলো নতুন নতুন জ্ঞান সৃষ্টি ও জ্ঞান বিতরণের জায়গা।

লেখক ঃ গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *