মোঃ সিরাজুল হক
প্রতি বছর রমজান মাস আসলেই দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়ে যায়। কেবল রমজান মাসই নয়, ঈদ, উৎসব বা অন্য সব পার্বণেও জিনিসপত্রের দাম বৃদ্ধি করে থাকে। এ সাধারণ কোন মূল্য বৃদ্ধি নয়, অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফার জন্য সিন্ডিকেট করে বাড়িয়ে দেয় প্রায় পণ্যের দাম। ভোক্তাকে ঠকানোর প্রতিযোগিতায় নেমে পড়ে। আবার যখন রমজান, ঈদ, উৎসব চলে যায় তখন আবার স্বাভাবিক হতে থাকে। কখনো কখনো আমরা পেশাগত মানুষের মাঝে আন্তরিকতা খুঁজে পাই। যেমন-লেখকের সাথে পাঠকের, শ্রোতার সাথে অভিনেতা। অবশ্য এ আন্তরিকতা কখনো স্বাভাবিক থেকে অস্বাভাবিক পর্যন্ত লক্ষ্য করা গেছে। অর্থাৎ দরদ বা ভালোবাসার জায়গাটি গভীর থেকে গভীরতা লক্ষ্য করা গেছে। কিন্তু ব্যতয় লক্ষ্য করা গেছে কেবল বাজার ব্যবস্থার ক্ষেত্রে। যেমন-ক্রেতা ও বিক্রেতা শব্দ দু’টি সম্পূরক ও অপূর্ব ছন্দমিল। অন্তরের মিলও থাকার কথা। কিন্তু শব্দ দু’টির মধ্যে ছন্দযুক্ত মিল থাকলেও মিল নেই কেবল ভাবে ও অন্তরে। কারণ, একজন ব্যবসায়ী পছন্দ করে অধিক মুনাফা বা লাভ। কম লাভে বেশি বিক্রি অধিক মুনাফা অর্জন করা যায় তা আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা ব্যবসার এ মন্ত্র সাধন করতে পারেনি। বাজার ব্যবস্থা লক্ষ্য করলে দেখা যায়, ব্যবসায়ীরা একটি নীতিতে সর্বদাই অটল তা হলো সময় এসেছে সুযোগ নাও। রমজান আসার আগেই একজন বড় পাইকারী পর্যায়ের ব্যবসায়ী সে সাধারণ দামে পণ্য সামগ্রী কিনে থাকে আর রমজানে বিক্রি করে অনেক বেশি দামে। একজন ব্যবসায়ীর মুনাফা লাভের আরও একটি পলিসি হলো-কমদামে পণ্য কিনে বেশি দামে বিক্রি করা। অর্থাৎ সাধারণ দামে কিনে সাধারণ দামে বিক্রি নয়। বরং অনেক বেশি দামে বিক্রি। প্রতি বছর রমজান মাস আসলেই আমরা বাজার সংশ্লিষ্ট কতকগুলো শব্দের সাথে পরিচিত হই। যেমন-বাজার সিন্ডিকেট, অবৈধ মজুতদার, বাজার অস্থিতিশীল, ক্রেতার নাবিশ^াস, নৈরাজ্যের বাজারে স্বস্তিতে নেই ভোক্তা, ক্রেতার মাথায় হাত, কথা রাখেন না ব্যবসায়ীরা ইত্যাদি। একথাগুলো কেবল বলার জন্য বলা নয়। বাজার যে এখন একটি কষ্টের জায়গা, দুঃশ্চিন্তার হাট তা ভুক্তভোগি নি¤œবিত্ত ও নি¤œ মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মানুষ হারে হারে টের পাচ্ছে।
প্রসঙ্গতঃ কারণে একটি প্রশ্ন, শতকরা ৯৫জন মুসলমানের দেশে শতকরা ৯৫জন ব্যবসায়ী হওয়ার কথা। অনুরূপভাবে শতকরা ৯৫জন রোজাদার না হলেও অন্তত ৮০জন লোক রোজাদার। রমজান মাস আসলেই মুসলিম ব্যবসায়ীরা বাজার সিন্ডিকেট করে, অস্থিতিশীল করে, দ্রব্যমূলের দাম বৃদ্ধি করে মুসলিম রোজাদারদের কষ্ট দেয়! অথচ পবিত্র রমজান মাসে মুসলিম ব্যবসায়ীদের উচিত পণ্যমূল্য ছাড় দিয়ে সর্বোচ্য ভ্রাতৃত্ববোধ, সম্প্রীতিবোধ ও সহমর্মীতা দেখানো। কিন্তু সম্প্রীতিবোধ তো দূরের কথা তার পরিবর্তে রোজাদারকে কষ্ট দেওয়াই যেন কর্তব্যে পরিণত হয়েছে। অথচ বিশে^ অনেক দেশে উৎসব পার্বণে নিত্যপণের স্বাভাবিক দামের চেয়ে ছাড় দিয়ে বিক্রি করা হয়। কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরছি-খৃষ্টান সম্প্রদায়ের বড় দিনে খৃষ্টান ব্যবসসায়ীরা পণ্য সামগ্রী ছাড় দিয়ে বিক্রি করে থাকে। কয়েক বছর আগেও দেখেছি বিশ^ ইজতেমা টঙ্গীর ময়দানে বাটা কোম্পানী ৩০% ছাড় দিয়ে মুসুল্লিদের খাসীর মাংস খাচ্ছে। ভারতে দূর্গাপূজা উপলক্ষ্যে বিশাল মূল্য ছাড় দিয়ে পণ্য সামগ্রী বিক্রি করে থাকে। আমাদের দেশে যশোর জেলা এক ব্যতিক্রমী বাজার দেখতে পাওয়া গেছে। ক্রেতার মুখে হাসি ফুটাতে স্বেচ্ছায় ঠকছে বিক্রেতা। যশোরের স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আইডিয়া সমাজকল্যাণ সংস্থা। স্বেচ্ছায় ঠকার প্রকল্প হাতে নিয়েছে তারা। ১২৮৭ টাকার বাজার মূল্যে ৯টি পণ্য কিনে তারা বিক্রি করছে মাত্র ৫৫০টাকায়। ৫২৭ নি¤œ ও মধ্যবিত্ত পরিবারের মধ্যে লস পণ্য সামগ্রী বিক্রয় করছে। সঙ্গতঃ কারণে একটি প্রশ্ন, অন্য ধর্মে লোকেরা যদি তাদের সম্প্রদায়ের লোকদের প্রতি উদার ধর্মীয় সম্প্রীতিবোধ দেখাতে পারে তবে বাংলাদেশের মুসলিম ব্যবসায়ীরা কেন তার ধর্মীয় ভাইদের প্রতি উদারতা দেখাতে পারে না? কেন সংকীর্ণতার পরিচয় দেওয়া হয়? কেনইবা সিন্ডিকেট করে রোজাদারকে কষ্ট দেয়া হয়? ইসলাম শ্রেষ্ঠ ধর্ম, উদার সম্প্রীতির ধর্ম এটা কি কেবল বক্তব্যই থেকে যাবে না কর্তব্যে পরিণত করতে হবে? বাঙালি মুসলমান বক্তব্যে ফাস্ট, লেবাজে ফাস্ট, জান্নাতের দাবিতেও ফাস্ট, সিন্ডিকেটে ফাস্ট, মুনাফাতেও ফাস্ট, আবার রমজান মাসে রোজাদারকে কষ্ট দিতেও ফাস্ট। ফাস্ট নয় কেবল ইসলামের নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠায়। এ কথাও সত্যি যতদিন না ইসলামের নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠা হবে ততদিন পর্যন্ত মুলমানিত্বের দাবি সম্ভব নহে। সুতরাং আগামী ঈদ, রমজান হোক ইসলামের নৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রতিশ্রæতি।