japa 22
বিশেষ প্রতিবেদনঃ
১৯৫২ থেকে ২০১৬, মাঝখানে কালের গহ্বরে বিলিন হয়েছে ৬৪ টি বছর। এর সাথে বিগত হয়েছে একটি শতাব্দী এবং আরো অনেক কিছু। কিন্তু কোনোদিন বিগত হবে না ৫২-এর একুশে ফেব্রুয়ারী কিংবা ৭১-এর ২৬শে মার্চ এবং ১৬ই ডিসেম্বর। এই তারিখগুলো আমাদের জাতীয় জীবনে চির নতুন হয়েই থাকবে। প্রতিনিয়তই মনে হয়- একুশ আসে কিন্তু ফিরে যায় না। মিশে থাকে হৃদয়ে- অন্তরের অন্তঃস্থলে, জড়িয়ে থাকে জিহ্বায়- ঠোঁটে। এমনকি স্বপ্নেও। কারণ আমরা যে স্বপ্ন দেখি। আমার চিন্তা-চেতনা-কল্পনা কখনো কখনো গভীর ঘুমের মাঝে স্বপ্ন হয়ে ভেসে ওঠে। সেই স্বপ্নে যখন কথা বলি বা কথা শুনি- তা শুধু আমার মায়ের মুখ থেকে শোনা ও শেখা ভাষাতেই বলি কিংবা শুনি। তখনও যেনো একুশ আমাদের জানিয়ে দেয় অথবা আমার চেতনায় জাগ্রত হয়- এখানেই ৫২-এর অস্তিত্ব বর্তমান। এই অস্তিত্বের কথা এখন জাতীয় পরিমণ্ডল ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বিস্তৃত হয়েছে।
একুশে ফেব্রুয়ারী মানেই তাবৎ দুনিয়ার আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাসে এক অনন্য সফলতার প্রতীক। বিশ্বের অন্যসব সফল আন্দোলনের মধ্যে একুশের একটা স্বাতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে। একুশ ছিলো একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের ফলশ্রুতি। সেই ফলশ্রুতির ধারাবাহিকতায় এসেছে আমাদের প্রিয় স্বাধীনতা। ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট ও ইতিহাস আমাদের সকলেই জানা। অমর শহীদ রফিক-শফিক-সালাম-বরকতের অবদানের কথা আমরা জানি। সেই বিস্তারিত আলোচনায় যেতে চাই না। বাংলাভাষায় উচ্চারিত ধ্বনির সাথে তারা মিশে আছেন। তাদেরই রক্তে রঞ্জিত বর্ণমালা আজ মুক্ত। একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পথ বেয়ে একটি জাতির হাজারো বছরের লালিত স্বাধীনতার স্বপ্ন যে বাস্তবে রূপ পেতে পারে- অমর একুশে সেটাই প্রমান করেছে। এই সাংস্কৃতিক আন্দোলনে যে তারুন্যের আশ্চর্য উদ্বোধন হয়েছিলো, তারই বিপুল প্রানশক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রেরনা জুগিয়েছিলো। একুশের মহালগ্নে বাঙালীর জাতীয়তাবোধের চেতনা আর ধনতান্ত্রিকতার বদলে গণতান্ত্রিকতার উন্মেষ প্রত্য সংগ্রামে উজ্জীবিত হয়েছিলো এক একটি প্রান, এক একটি শপথ, এক একটি বজ্রমুষ্ঠি। সেই শপথ, দৃঢ়তা আর বজ্রমুষ্ঠি ধীরে ধীরে পরিনত হয়েছিলো তখনকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের শক্তি-সংগ্রাম-বিক্ষোভে। তাই একুশে থেকে আমাদের বারে বারে শিক্ষা নিতে হয়।
৫২-এর ভাষা আন্দোলনের সময় আমি ছিলাম যৌবনের টগবগে তরুণ। তবে তখন আমি জড়িয়ে পড়েছি দেশ রার অঙ্গীকারে সৈনিক জীবনে। ওই বছরে আমি সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেছি। তখন বদলে গেছে আমার জীবনের ধারা। কলেজ জীবনে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছিলাম সাহিত্য চর্চায় মগ্ন। সে সময়ে আমার কাঁচা হাতের লেখাগুলো কিছুই সংগ্রহে নেই আজ। এর সাথে খেলাধুলায়ও আগ্রহী ছিলাম সমানভাবে। রাজনীতি তখন আমাকে এতোটুকুও স্পর্শ করেনি। কখনো রাজনীতি করবো- এটা ছিলো কল্পনারও বাইরে। কিন্তু জীবনের বাঁকেবাকে পাল্টে গেছে আমার কর্ম-সাধনা-ইচ্ছা-আশা-আকাঙ্খার গতিধারা। ১৯৫০ সালে যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলাম, তখন পাকিস্তানী শাসন শোষন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে বাঙালীর ক্ষোভ বিদ্রোহ দানা বেঁধে উঠছিলো। সেই সময়ে বাঙালীর ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আমার নৈতিক সমর্থন থাকলেও প্রত্যভাবে ওই রাজনৈতিক আন্দোলনে আমার অংশগ্রহন ছিলো না। যদিও ভার্সিটিতে ভর্তি হবার পর ছাত্র ইউনিয়নের সাথে জড়িত হয়েছিলাম তবে ভার্সিটির ক্রীড়াঙ্গনেই ছিলো আমার পদচারণা। সেখানে আমি সফল ছিলাম। ভার্সিটির ক্রীড়াদলের সাথে সম্পৃক্ত হবার কারণে ওই সময়ে রাজনৈতিক আন্দোলনে অংশগ্রহনের সময় ও সুযোগ আমার ছিলো না। ইতিমধ্যে সেনাবাহিনীতে যোগদানের একটা সুযোগ এসে গেলো। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান আমি। অনেক ভাই-বোনের লেখাপড়া চালিয়ে যেতে আমার বাবাকে বেগ পেতে হতো। তার কষ্ট আমি অনুভব করতাম। তাই ভার্সিটি জীবন শেষ না করেই আমাকে কর্মজীবনে ঢুকতে হলো। তৎকালীন সময়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে অফিসার পদে বাঙালীদের নিয়োগ পাওয়া ছিলো দুঃসাধ্য ব্যাপার। এখানে ছিলো পাকিস্তানের দুই অংশের মধ্যে চরম বৈষম্য এবং পূর্ব বাংলার প্রতি সীমাহীন বঞ্চনা। ১৯৫১ সালে আমি সেনাবাহিনীতে যোগ দিলাম।
১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে আমাকে চলে যেতে হলো পশ্চিম পাকিস্তানে। যাহোক, ওখানে কর্মরত অবস্থায় জানতে পারলাম- আমাদের ভাষা আন্দোলন সফল হয়েছে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। সেদিনের সেই আনন্দের কথা আজো ভুলতে পারি না। সেই বিজয়ে অনুভব করেছিলাম- মুক্তির স্বাদ। মূলতঃ ভাষার প্রশ্নেই তো আমরা পশ্চিমাদের কাছ থেকে মানষিকভাবে আলাদা হয়ে পড়েছিলাম। অমর একুশের মাধ্যমে যে স্বাধীনতার বীজটি রোপিত হয়েছিলো, ৫২ থেকে ৭০- এই দেড় যুগ সময়ে সেটি অঙ্কুরিত হয়ে ক্রমে বিশাল বটবৃক্ষের আকার ধারণ করে। শেষ পর্যন্ত এলো কাঙ্খিত স্বাধীনতা।
আজ আমরা মহা গর্বের সাথে পালন করি মহান একুশে ফেব্রুয়ারী- আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। এই দিনে বিশ্বের প্রতিটি দেশ স্মরণ করে বাংলাদেশের এক কালজয়ী আন্দোলনের কথা। তাই আজকের প্রেক্ষাপটে যে কথা বলতে চাই তা হলো- আমাদের গৌরবের ইতিহাস তো কম নেই। যশ-খ্যাতি-সম্মান নিয়ে আমরা তো স্বাচ্ছন্দ্যে বেঁচে থাকতে পারি। কিন্তু তাতে প্রতিবন্ধকতা আসে কেনো ? গলদটা কোথায়! পাকভারত উপমহাদেশের মধ্যে সবচেয়ে সমৃদ্ধ-সুজলা-সুফলা অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশের খ্যাতি সর্বজন বিদিত। বহু প্রাচীন কাল থেকে এখানে বহু বিদেশী লুটেরাদের থাবা পড়েছে। গোটা উপমহাদেশের সাথে এক নাগাড়ে ১৯০ বছর পরাধীন থাকার পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছিলাম। কিন্তু সেই স্বাধীনতার অলক্ষ্যে ছিলো আর এক পরাধীনতার নাগপাশ। সেই নাগপাশ ছিন্ন করতে, ২৩ বছর সময় লেগে গেছে। তারপর কেটে গেলো আরো ৩৫টি বছর। একটি মুক্ত দেশে- একটি স্বাধীন জাতির জন্য সাড়ে তিন দশক কম সময় নয়। আমাদের চেয়ে সম্পদে গৌন, শিক্ষা-সংস্কৃতিতে অনগ্রসর, কর্মে অদক্ষ, এমন একাধিক দেশ এগিয়ে গেলো- আর আমরা পড়ে রইলাম পেছনে। শুধু পেছনে পড়ে থাকাই নয়, ক্রমেই চলে যাচ্ছি উন্নয়নশীল দেশের পেছনের সারিতে। বলা যায়- এখন আমাদের অবস্থান অনুন্নত দেশের তালিকায়। শুধু যে পিছিয়ে পড়েছি তাও নয়, একটি দেশের জন্য নিকৃষ্টতম কলঙ্কের কালিমাও লেপটে আছে আমাদের কপালে। বিশ্বের মধ্যে শ্রেষ্ঠ দুর্নীতিগ্রস্থ দেশের তালিকায় আছি আমরা। এখানেই তো শেষ নয়। সন্ত্রাসী, অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রের বদনামও জুটেছে আমাদের ভাগ্যে। অথচ আমাদের ইতিহাসেই লেখা আছে অনেক গৌরবের কথা। আমরা ভাষার জন্য জীবন দিয়ে মাতৃভাষাকে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছি। আমরা ৯ মাস স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে এনেছি। এই যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষকে জীবনাহুতি দিতে হয়েছে। বিশ্বের মুষ্টিমেয় দেশ বাদে বর্তমান দুনিয়ার মহাপরাক্রমশালী আমেরিকাসহ অধিকাংশ দেশ কোনো না কোনো সময়ে পরাধীন ছিলো। আন্দোলন, সংগ্রাম ও যুদ্ধ করে পরাধীন দেশগুলোকে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়েছে। কিন্তু কোনো দেশের স্বাধীনতার জন্য আমাদের মতো এতো প্রান বিসর্জন দিতে হয়নি। অথচ সেই ত্যাগের মূল্য আমরা রাখতে পারছি না।
কেনো? কোথায় আমাদের ব্যর্থতা? আমি নির্দ্বিধায় বলতে পারি- আমাদের জাতি ব্যর্থ নয়। আমরা রাষ্ট্র পরিচালনায় সঠিক নেতৃত্ব প্রদান করতে পারছি না। নেতৃত্বের সফলতার জন্য সুষ্ঠু গণতন্ত্রের বিকাশ প্রয়োজন। সেখানেই থেকে যাচ্ছে বড় ঘাটতি। আমিও রাষ্ট্রমতায় ছিলাম। ৯ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেছি। আমার ক্ষেত্রেও ব্যর্থতা সফলতা উভয়ই ছিলো। কিন্তু কোন দিকে পাল্লা ছিলো ভারি- সেটাই হওয়া উচিৎ বিবেচ্য বিষয়। অবশ্যই আমি নিজেকে পর্যালোচনা করি। আমার নেতিবাচক দিক কি আছে তা যাচাই-এর চেষ্টা করেছি। একটি নেতিবাচক দিক হলো- আমি গণতান্ত্রিকভাবে ক্ষমতা গ্রহন করিনি। তবে নিয়মতান্ত্রিকতার যে বাইরে গেছি- তা নয়। কারণ আমার মতো পন্থায় তার পূর্বেও আমাদের দেশে ক্ষমতার রদবদল হয়েছে এবং বিশ্বের আরো অনেক দেশেও তার দৃষ্টান্ত আছে। দেখার বিষয় হওয়া উচিৎ- “জন্ম হোক যত্র-তত্র, কর্ম তার বড়” কিনা। সে দিক থেকে তো আমি দৃঢ়ভাবে বলতে পারি- দেশের জন্য আমি যতোটা কল্যান ও মঙ্গল করতে পেরেছি- আর কোনো সরকারের পক্ষে তা সম্ভব হয়নি।
পাশাপাশি ক্ষমতা গ্রহনের কথায়ও আসা যাক। আমি দেশের যে প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রক্ষমতা গ্রহন করতে বাধ্য হয়েছিলাম, আক্ষরিক অর্থে ঠিক সেই রকম না হলেও একই রকম সংকটের কারণে দেশে কিছুদিন আগে জরুরী অবস্থা জারি করতে হয়েছে। এই জরুরী অবস্থাকে দেশের মানুষ যেমন স্বাগত জানিয়েছে, আমার ক্ষমতা গ্রহনের ফলেও তখন দেশবাসী শান্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পেরেছিলো। এবার দেশে যে ভয়াবহ সংকটের সৃষ্টি হয়েছিলো, সেখান থেকে পরিত্রাণ পেতে জরুরী অবস্থা ছাড়া আর কি কোনো বিকল্প ছিলো?
পূর্বেই বলেছি, ৫২-এর সেই মহান আন্দোলনের অন্তরালে লুকিয়ে ছিলো ধনতান্ত্রিকতার বদলে জাতিয়তাবোধের চেতনায় উজ্জীবিত হওয়া আর গণতান্ত্রিকতার উন্মেষ ঘটানো। সেই কারনেই বলেছি- একুশের কাছে আমাদের বারে বারে ফিরে যেতে হবে এবং সংকটে ও সমস্যায় শিক্ষা নিতে হবে। ইতিপূর্বে আমাদের জাতীয় জীবনে যে মহা সংকট নেমে এসেছিলো- তার প্রধান কারন আমরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারিনি। নির্বাচনের মাধ্যমে একটি সরকার গঠিত হলেই গণতন্ত্র কায়েম হয়ে যাবে এটা ধরে নেয়া যায় না। অন্তত: ১৯৯১ থেকে ২০১ ৬-এর মধ্যে রাষ্ট্রপরিচালনার ধরণ-ধারনে সেটাই প্রমান হয়েছে। গণতন্ত্র আর প্রতিহিংসাপরায়নতা পাশাপাশি চলতে পারে না। গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হচ্ছে পরমত সহিষ্ণুতা, পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং অহিংস নীতির চর্চা। কিন্তু গত পনের বছরে এর কোনোটাই আমরা দেখতে পেলাম না। দেখেছি- গণতন্ত্রের লেবাসে এক পক্ষ আর এক পক্ষকে শুধু দমন করা নয়- নিশ্চিহ্ন করে দেবার প্রবনতা, পরস্পরের প্রতি ঘৃণা আর অবজ্ঞা, পরস্পরকে সহ্য করতে না পারা, এমনকি ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠানেও পাশাপাশি বসতে না পারা, দেখেছি হিংসা বিদ্বেস হানা-হানি এবং যথেচ্ছাচার নির্লজ্য মিথ্যাচার। সংসদের ভিতরকার কথা এই মুহুর্তে আর নাই বা বললাম। গণতন্ত্রের ছদ্মাবরনে যে কুৎসিত কাজগুলো হয়েছে- তারই বাহাস চর্চা হয়েছে সংসদে। সত্যিকার গণতন্ত্রের উন্মেষ ঘটাতে আমরা পারলাম না। অথচ এই গণতন্ত্রের জন্য অনেক আন্দোলনও হয়েছে। আমিও ক্ষমতা গ্রহণ করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছি। তখন আমার কোনো রাজনৈতিক দল ছিলো না। আমি ১৯৮৪ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দিয়েছিলাম। আর আমার দল গঠিত হয়েছে ১৯৮৬ সালের জানুয়ারী মাসে। ৮৪ সালে রাজনৈতিক দলগুলো বেঁকে বসলো- তারা সামরিক আইনের মধ্যে নির্বাচন করবে না। তখন যদি তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতেন তাহলে বাইরে থেকে এসে তো কেউ জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন না। যারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করতেন তারাই তো জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হতেন। তখন নির্বাচন বর্জন করে রাজনৈতিক দলগুলো ভুল করেছিলো না ঠিক করেছিলো- নিশ্চিয়ই পরবর্তীতে তার মূল্যায়ন তারা করেছেন। এখন দেশে জরুরী অবস্থা কার্যকর রয়েছে। এখন যদি এই জরুরী অবস্থা প্রত্যাহার করতে হয়- তাহলে অবশ্যই সাংবিধানিক শূণ্যতা সৃষ্টি হবে। কারণ জরুরী অবস্থা জারির বিষয়টি সংবিধান স্বীকৃত। তাহলে নির্বাচন করতে হবে জরুরী অবস্থার মধ্যেই। এখন যদি বলা হয় যে, জরুরী অবস্থার মধ্যে নির্বাচনে অংশ গ্রহন করা যাবে না- তাহলে আবার আর একটা সংকট সৃষ্টি হবে। আমার ধারনামতে জরুরী অবস্থার মধ্যেই নির্বাচন করতে হবে। এছাড়া আর কোনো বিকল্প থাকবেনা। সে ক্ষেত্রে হয়তো জরুরী অবস্থা শিথিল করতে হবে এবং অনেক মৌলিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
জরুরী অবস্থা জারি হোক এটা আমাদের প্রত্যাশিত ছিল না। গণতান্ত্রিক পরিবেশ যদি বিনষ্ট না হতো- তাহলে জাতি কোনো ভাবেই জরুরী অবস্থা জারির প্রত্যাশা করতো না। সুস্থ্য-সবল দেহে কেউ অস্ত্রপচারের কথা চিন্তাও করে না। কিন্তু দেহে যদি মারাত্মক অসুখ দেখা দেয় তাহলে সেরে ওঠানোর জন্য প্রয়োজনে মারাত্মক অস্ত্রপচারেরও প্রয়োজন হয়। তার জন্য একান্তভাবে অস্ত্রপচারের মতো চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। ১৯৮১-৮২ সময়ে রাষ্ট্রপরিচালনায় সৃষ্টি সংকটের মতো এবার অন্যধাচে দেশে রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি হবার প্রেক্ষাপটে দেশের মানুষ তেমনি একান্তভাবেই জরুরী অবস্থা জারি প্রত্যাশা করেছিলো। সত্যি বলতে কি এই জরুরী অবস্থাই সুদুর প্রসারি বিপর্যয় থেকে দেশকে রক্ষা করেছে। লক্ষ্যনীয় বিষয়টি হলো এই যে, দুই বারেই সংকট সৃষ্টি হয়েছে ক্ষমতাসীন একটি দলের দায়িত্বহীনতা, একগুয়েমী, ব্যর্থতা, দুর্নীতি এবং গণতন্ত্রচর্চায় অনীহার কারণে। এদের মাধ্যমে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের কারণে সুষ্ঠু রাজনৈতিক বিকাশটাই বাধাগ্রস্থ হয়েছে। শুধু ক্ষমতার লোভে ন্যায়-নীতি আদর্শ বিসর্জনের ফলে গোটা রাজনৈতিক পরিবেশটাই কলুষিত হয়ে গেছে। এই দলটি তিনবার ক্ষমতায় এসেছে এবং একটা ভূয়া নির্বাচনের কথা যোগ করলে দাড়ায় মোট চারবার। আরো লক্ষনীয় যে- এই চারবারের মধ্যে কোনোবারেই তাদের বিদায় সুখকর ছিলো না। প্রথমবার দুর্নীতি ও ব্যর্থতার দায়ভার স্বীকার করে সেনাবাহিনীর কাছে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়া হলো, দ্বিতীয়বার গণ আন্দোলনের মধ্যে ক্ষমতা ছেড়ে দিয়ে একটা ভূয়া নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হলো, তৃতীয়বারের সরকার টিকেছে ১১ দিনের মতো, আর এই চতুর্থবার ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার পর এদেরই ষড়যন্ত্রে উদ্ভুত পরিস্থিতির কারণে জরুরী অবস্থা জারি করে দেশকে রক্ষা করতে হলো।
যাহোক, দেশের রাজনৈতিক কলেবরে যে পচন ধরেছিলো মনে হয় সেখানে যথাসময়ে অস্ত্রপচার হয়েছে। আশা করি এই শৈল্য চিকিৎসায় সুফল আসবে। প্রত্যাশা করি যত দ্রুত সম্ভব তস্থান শুকিয়ে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসবে।
আমি ভীষণভাবে আশাবাদী মানুষ। আশা করি, আমরা গৌরবের আসনে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবো। যুদ্ধের পরে শান্তি প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেখা দেয়। আজকের জাতিসংঘ একটি মহাযুদ্ধের ফলশ্রুতিতেই শান্তির জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সব কিছু ভাসিয়ে নেয়া বন্যার ফেলে যাওয়া পলিতেই আবার সোনার ফসল ফলে। তেমনিভাবে আমাদের রাজনৈতিক অঙ্গনে যে দুর্দশা- বিশৃঙ্খলা এবং অনৈতিকতার অনুপ্রবেশ ঘটেছিলো- সেখান থেকে এবার উত্তরনের সময় এসেছে। সামনে আছে আমাদের জাতীয় নির্বাচন। আশা করি আমরা সম্মিলিতভাবে একটি সুষ্ঠু- অবাধ ও নিরপে নির্বাচন অনুষ্ঠানের মধে দিয়ে প্রমান দিতে পারবো- আমরা গণতন্ত্র বিকাশের পথে এগিয়ে যাচ্ছি। গত তিনটি জাতীয় নির্বাচন সম্পূর্ণ নিরপেভাবে অনুষ্ঠিত না হলেও মোটামুটি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলা যায়। তবে এই নির্বাচনগুলোতে যেভাবে কালো টাকার খেলা হয়েছে- তাতে সব ক্ষেত্রে সৎ- যোগ্য-দক্ষ ও সুশিক্ষিত প্রার্থী বিজয়ী হয়ে আসতে পারেননি। যেন-তেন প্রকারে দলীয় প্রার্থীর বিজয় নিশ্চিত করার জন্য ত্যাগী রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে বঞ্চিত করে তাদের স্থলে অর্থ ও অস্ত্র নির্ভর এবং সন্ত্রাসীর গডফাদার ধরনের প্রার্থী মনোনীত করা হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে। ফলে সংসদ কার্যকারিতা হারিয়েছে। এখন রাজনীতিকে আবার কলুসমুক্ত করার তাগিদ দেখা দিয়েছে। গণতন্ত্রের জন্য সুষ্ঠু রাজনীতির কোনো বিকল্প নেই। এবার আশা করি, রাজনীতিকে রাজনীতিকদের হাতে তুলে দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হবে। দুর্নীতিবাজ- সন্ত্রাসী ও সমাজবিরোধীদের কঠোর হাতে দমন করে সৎ- যোগ্য ও দক্ষ জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে বর্তমান প্রশাসন সচেষ্ট থাকবে বলেই আমার কাছে প্রতীয়মান হয়। আশা করি অতীতের সব গ্লানিকর অধ্যায়গুলো মুছে- আবার নতুন করে মঙ্গল ও কল্যাণের সোপান এবার গড়ে উঠবে।
প্রতি বছর ফেব্রুয়ারী এলেই আমাদের মধ্যে একটা পবিত্র চেতনা জাগ্রত হয়। এবারও তার ব্যতিক্রম কিছু ঘটেনি। এবার একুশ এসেছে এক চরম বিরূপ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের প্রত্যাশা নিয়ে। ৫২-এর একুশ দিয়েছিলো এক নতুন পথের দিশা। তারপর কেটে গেলো বহু চড়াই-উতরাই পথ। ৬৪ বছর পর আর একটি একুশ এলো অনেক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করে। আর আমরা ব্যর্থ হতে চাইনা। এবার এক নতুন দিগন্তের সুচনা করতে একুশের চেতনায় স্নাত হয়ে গড়ে তুলতে চাই একতার মিলন মেলা। জাতীয় জীবনের এই পবিত্র মাসে আহ্বান জানাই গোটা জাতির কাছে- আসুন সবাই আবার আমরা ঐক্যবদ্ধ হই- ৫২ এবং ৭১-এর মতো। আসুন আমরা সবাই ভুলে যাই হিংসা বিদ্বেষ হানাহানি- ভুলে যাই স্বার্থের সংঘাত। দুর্নীতি, দুঃশাসন- সন্ত্রাসসহ সকল অনাচার-অবিচারের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে গড়ে তুলি নতুন এক বাংলাদেশ। এটাই হোক- এবারের একুশের অঙ্গিকার।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *