মোঃ হামিদুল হক জেলা প্রশাসক রাজশাহী
দেশে করোনা পরিস্থিতি শুরুর সময় সরকার বিদেশ থেকে আগত মানুষদের কোয়ারান্টাইনে রাখার প্রচেষ্টা গ্রহণ করে আশকোনা হজ্বক্যাম্পে নিয়ে যায়। সেদিন আমরা কিছু মানুষের মাতৃভূমির নিয়ম কানুন ও মাতৃভূমির প্রতি যে বিরূপ মন্তব্য শুনেছি তা কোনও ভদ্রলোকের মুখ দিয়ে বের হবার কথা নয়।আমরা সেদিন আমাদের পুলিশ সদস্যগণের যে ধৈর্য দেখেছি,যে প্রফশনালিজমের পরিচয় তারা দিয়েছেন তা অনন্য।এর পরের নানান ঘটনা।

১. আশকোনার তিক্ত অভিজ্ঞতা থেকে বিদেশ থেকে আগত মানুষদের তার নিজ বাড়িতে হোম কোয়ারান্টাইনে রাখার জন্য সরকার তালিকা করে প্রত্যেেক জেলার জেলা প্রশাসক ও পুলিশ সুপারের কাছে পাঠায় হোম কোয়ারান্টাইন নিশ্চিত করার জন্য। দুঃখ জনক ভাবে বিদেশ থেকে আশা অর্ধেক মানুষ তাদের প্রদ্ত্ত ঠিকানায় না ফিরে আত্ম গোপন করে। হন্নে হয়ে খুঁজতে খুঁজতে যাঁদের ঠিকানা পাওয়া যায় তাদেঁর হোমকোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে প্রশাসন,পুলিশ,জনপ্রতিনিধি সকলকে কঠোর পরিশ্রম ও সময় ব্যয় করতে হয়। তাও ফাঁক ফোঁকর পেলে তাঁরা শ্বশুর বাড়ি ও আত্মীয় স্বজনের বাড়ি ঘুরে আসে, সিগারেট ও চা খেতে বের হয়। সরকারি লোক গেলে বাড়ির অন্যরা বলে সবাই বাড়িতে আছেন।

২. সরকার ২৫ মার্চ থেকে সরকারি ছুটি ঘোষণা করে স্কুল কলেজ ছুটি দেয় শিশু ও শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনের অংশ হিসেবে। সরকার ২৬ মার্চ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসের কর্মসূচি বাতিল করে এবং তারপূর্বে গত এক বছর ধরে প্রস্তুতি নেয়া জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উদযাপনের সকল কর্মসূচি বাতিল করে জনস্বার্থে।কিন্তু জনগণ এটিকে অবকাশ যাপন হিসেবে গ্রহণ করে কক্সবাজার সহ পর্যটন কেন্দ্র গুলোতে হুমড়ি খেয়ে পড়ে।ফলে সরকার সকল প্রকার পাবলিক পরিবহণ বন্ধ করে দেয়। গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি গুলো বন্ধ ঘোষণা করে।

৩. বাঙালি চরিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ একটু সুযোগ পেলেই গ্রামে ছুটে যাওয়া, তা ইদ হোক, পূজা হোক, আর জাতীয় দুর্যোক হোক। তাইতো শত বাধা পেরিয়ে, সাত নদী,তের বিল পার হয়ে, যে যেভাবে পারছে ঢাকা ছেড়ে গ্রামে ছুটে গেলো। সাথে নিয়ে গেলো নিজের শরীরে ঘর বাধা করোনা ভাইরাস। করোনা ছড়িয়ে পড়লো প্রায় সারাদেশে।লক ডাউন করা হলো ঢাকা, নারায়নগঞ্জ,গাজিপুর। প্রশাসন পুলিশ, আর্মি শত চেষ্টা করেও থামাতে পারলো না তাদের ঘরে ফেরা।কিন্তু গ্রামে গিয়ে আরেক ঝামেলা তারা কোন ভাবেই হোম কোয়ারান্টাইন এ থাকবেন না। তাদের পিছনে সরকারি সংস্থাগুলোকে ব্যাপক শ্রম দিতে হয়।

৪. করোনা মোকাবিলায় হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা, ডাক্তার,নার্স ব্যবস্থাপনা,তাদের নিরাপত্তা সামগ্রী সংগ্রহ সাহস যোগানো, ইত্যাদিতে প্রচুর সময় ব্যয় করতে হয়।বিদ্যমান চিকিৎসা কাঠামোর মধ্যেই করোনার জন্য পৃথক চিকিৎসার আয়োজন করতে হাসপাতাল ও স্বাস্থ বিভাগকে নতুন ভাবে সাজাতে হয় সবকিছু। সারা বিশ্ব একসাথে করোনা আক্রান্ত হওয়ায় এসংক্রান্ত চিকিৎসা সামগ্রী আন্তর্জাতিক বাজার থেকে পিপিআর ও পিপিএ অনুসরণ করে ক্রয় করতে সরকারের মিনিমাম যতটুকু সময় লাগে সেসময়ের মধ্যে সরকার তা সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়। তবে সমালোচকগণ এসব সাগ্রীর মান ও পরিমান নিয়ে তুখোর সমালোচনা করেন। দুঃখজনক ভাবে একজন ডাক্তার সহ কিছু মানুষ প্রাণ হারান।

৫.অপরদিকে পর্যায়ক্রমে জেলা সমূহ লকডাউন করা, মানুষকে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা, বাইরে বের হতে নিরুৎসাহিত করা, মসজিদ ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে যাতায়াত সীমিত করা ইত্যইত্যাদি কারণে লোজজনের কর্মসংস্থান সীমিত হওয়ায় এবং খাদ্য সংকট মোকাবিলায় সরকারি ত্রাণ কার্যক্রম চালু করা হয়। অন্য যেকোন দুর্যোগের তুলনায় করোনা দুর্যোগের ত্রাণ বিতরণ একটি ভিন্ন মাত্রা যোগ করে আর তা হলো ত্রাণ ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে বিতরণ করা। সরকারি দপ্তর সমূহের কর্মকর্তা কর্মচাটী,স্হানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান সমূহের জনপ্রতিনিধি,রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মী, সামাজিক সংগঠন সমূহ,এনজিও আপ্রাণ চেষ্টা করে খাদ্য সংকটে থাকা মানুষের কাছে ত্রাণ পৌঁছাতে। কিন্তু অনেক দুঃখের সাথে লক্ষ্য করা যায় কিভাবে যেনো সবার ঘরের খাবার শেষ হয়ে গেলো।অবস্থা সম্পন্ন অনেক মানুষ সরকারি ত্রাণ পাবার জন্য চেষ্টা শুরু করল। ফলে প্রকৃত গরীবের ঘরে খাবার পৌঁছানো একাজে সম্পৃক্ত কর্তৃপক্ষের জন্য কঠিন হয়ে পড়া শুরু করল। তার উপর, স্থানীয় রাজনীতির ভিলেজ পলিটিক্স, সরকার বিরোধীগণের উস্কানী, হলুদ সাংবাদিকতা, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপরিপক্ক ব্যবহার বিষয়টিকে ঘোলাটে করার অপচেষ্টা করলেও প্রশাসন তা শক্তহাতে নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়।

৬. ধর্মীয় অনুভূতির দিক থেকে বাঙালি ভীষণ প্রখর। সারা বছর নামাজ না পড়লেও রমজানে নামাজ পড়ে তাও জামায়েত করে। কিন্তু সরকার যেহেতু করোনার কারণে সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে জনস্বার্থে
মসজিদ গুলোতে নামাজির সংখ্যা সীমিত করেছে, তাই এবার বাঙালির মসজিদে নামাজ পড়ার অন্তর আত্মা আরও কেঁদে উঠে মসজিদে যাওয়ার জন্য। সারা বছর, সুদ, ঘুষ,চিটিং,অধিক মুনাফা, ঠকানো এসব কাজ করলেও রোজার মাসে বাহ্যিক ও হৃদয় ফুলের মতো পবিত্র হয়, লেবাস দেখলে বুঝার উপায় নাই তিনি কদিন আগেও কতো খারাপ কাজ করেছেন।সরকারের উপর ক্রমাগত চাপ আসতে থাকে মসজিদ খুলে দিবার জন্য। অবশেষে অন্যান্য আর্থ- সামাজিক বিষয়ের সাথে সামঞ্জস্য রেখে সরকার মসজিদে নামাজ আদায়ের নির্দেশনা জারি করে। আহা বাঙালির মনে কি প্রশান্তি।
৭. এদিকে টেলিভিশনের টকশো যেনো কোন ভাবেই জমছে না।অনেকের সুপ্ত বাসনা ৫০ দিন অতিবাহিত হলো, বিশ্বের বড় বড় সমরাস্ত্রে শক্তিশালী রা্ষ্ট্র সমূহ করোনায় ঘায়েল হলো; তাদের হাজার মানুষ মারা গেলো, কিন্তু বাঙালির কী কই মাছের প্রাণ,দুর্বল একজন গার্মেন্টস কর্মী শীর্ণ দেহ যে শত মাইল হেটে ঢাকা থেকে বাড়ি আবার বাড়ি থেকে ঢাকা এলোগেলো করোনা আক্রান্ত হয়েও বেঁচে গেলো। এসব অনেক আলোচকের মনের ভীতর একধরনের আকুতি, মাননীয় প্রধান মন্ত্রীকে বেকায়দায় ফেলতে যারা কিছু লাশের অপেক্ষায় রয়েছেন, তারা কেমন যেনো অসস্তির মধ্যে আছেন। তারা বাংলাদেশর রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও আমলাতন্ত্রকে ব্যর্থ প্রমানে নিদারুণ প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন কিন্তু কিছুতেই সফল হচ্ছেন না, তিনি ডাক্তার না হয়েও, অন্য কোন পেশার হয়েও করোনা বিশেষজ্ঞ হয়েছেন এবং অনবরত বক্তৃতা দিচ্ছেন তিনি কিছুতেই সুবিধা করতে পারছেন না। ফলে তার গায়ে জ্বালাপোড়া শুরু হয়েছে।

৮. আমাদের দেশ ছোট, ছোট অর্থনীতি মানুষ গিজগিজ।অনেকে ফেসবুক বা সোশাল মিডিয়ায় অনেক দেশের সুব্যস্থাপনার মডেল দেখিয়ে বলে আমরা কেনো পারিনা।মনে রাখতে হবে সেসব দেশের আয়তনে তুলনায় মানুষ অনেক কম।আর মানুষের নীতি নৈতিকতা অনেক বেশি।যে দেশে টিসিবি’র পণ্য দিনে একাধিক বার কেনার জন্য লাইনে তিনবার দাড়ায়, যে দেশে ত্রাণ গ্রহনের জন্য নিজে ছাড়া আর কারও কথা মনে আসে না, সেখানে শৃঙ্খলা রক্ষা করা যে কতো কঠিন বলে বুঝানো যাবে না।
৯. ছোট বেলায় একটি কবিতার কয়েকটি লাইন মনে পড়লো। ” আজব দেশের আজব রাজা, দেশ জোরা তার নাম, থামলে বলে চলরে তোরা, চললে বলে থাম।”
কিন্তু এখন বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রেখে বলছি, কিছু কিছু মানুষের আচরণ এমন হয়েছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা একটু কঠোর হলে বলে এরা এতো খারাপ, ফেসবুক ও হলুদ সাংবাদিকতায় চৌদ্দ গোষ্ঠী উদ্ধার করে, যিনি চাকরি করেন শুধু তাকে না, তার বংশের সকল মানুষের মিডিয়া ট্রাল করে ফলেন।আবার এই একই মানুষ ভারতের পুলিশ যখন লক ডাউন মানাতে বেধরক পিটায়, সেই পিটুনির ভিডিও শেয়ার করে বাঙালিকে এমন পিটুনি দিতে পুলিশকে দাওয়াত দেয়। কিন্তু বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এখন অনেক মেচিউরড, প্রশাসন অনেক মেচিউরড, কারও পাতানো ফাঁদে তারা পা দিবে না। তাইতো সমালোকরা এখন আর সুবিধা করতে না পেরে যত দোষ, নন্দ ঘোষ, রাজনীতিবিদ আর আমলাদের দিন রাত গালি দিয়ে প্রশান্তির ঘুম ঘুমায়, আর রাজনীবিদ ও আমলারা (সকল পেশাজীবি সহ)দিন রাত পরিশ্রম করে সমালোচকদের প্রশান্তির ঘুম যেনো নষ্ট না হয়, খেটে খাওয়া মানুষ যেনো কষ্ট না পায়, সে চিন্তা ও কাজ করতে করতে নির্ঘুম দিনরাত কাটায়। সেই রাজনীতি বিদ, সেই আমলা,সেই জনপ্রতিনিধিই প্রত্যাশা করে ভালো থাকুক বাংলাদেশ, ভালো থাকুক এদেশের সকল মানুষ এমন কি সকল সমালোচক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *