(মতামতের জন্য সম্পাদক দায়ী নয়)

সিরাজী এম আর মোস্তাক, ঢাকাঃ ওরা প্রশাসনের ছত্রছায়ায় মুক্তিযোদ্ধাকোটা বহালের দাবীতে আন্দোলন করছে। ওরা দাবি করছে, বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওদের জন্য মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালু করেছেন। বঙ্গবন্ধু তো বাঙ্গালি জাতির পিতা, তিনি কিভাবে তাঁর সমগ্র জাতিকে বঞ্চিত করে শুধু ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা ও তাদের সন্তানদের কোটাসুবিধা দিয়েছেন? ডাহা মিথ্যা কথা। বঙ্গবন্ধুর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পেয়েছেন, এমন কোন প্রমাণ কি ওদের আছে? মোটেও নেই। বঙ্গবন্ধু যদি ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করতেন, তাহলে ৩০লাখ বীর শহীদের ঘোষণা কেন দিয়েছেন? তার মানে, ওরা বঙ্গবন্ধু ঘোষিত ৩০লাখ বীরশহীদদের মুক্তিযোদ্ধা মানেননা। ওরা বলেই যাচ্ছেন- বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা, ভাতা ও তাদের সন্তানদের জন্য কোটা চালু করেছেন। এতে কি ওদের মুক্তিযোদ্ধা বা বঙ্গবন্ধুর আদর্শে বিশ্বাসী বলা যায়?

স্বাধীনতার পর দেশ ছিল অন্তসারশূণ্য। এ ভঙ্গুর দেশকে বঙ্গবন্ধু খুব কম সময়ে সাবলম্বী করেছেন। তিনি যদি পক্ষপাতিত্ব বা কোটা চালু করতেন, তাহলে কি দেশ গড়তে পারতেন? মোটেও নয়। তিনি দেশে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা বৈষম্য ও তাদের কোটা দূরের কথা, চাকুরি ক্ষেত্রে বয়সের সীমাবদ্ধতাও রাখেননি। দেশ সেবায় সবাইকে উদাত্ত আহবান করেছেন। যাকে যেভাবে পেরেছেন, দেশের কাজে লাগিয়েছেন। এমনকি তিনি যুদ্ধকালে পাকিস্তান সরকারে কর্মরতদেরকেও সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করে দেশ সেবায় বহাল রেখেছেন। এমন মহান আদর্শের পিতার প্রতি মুক্তিযোদ্ধা কোটা চালুর অপবাদ কি বাড়াবাড়ি নয়?

বাংলাদেশে ৫৬ভাগ কোটা প্রচলিত। এতে ১০ভাগ করে জেলা ও নারী কোটা, ০৫ভাগ উপজাতি কোটা, ০১ভাগ প্রতিবন্ধী কোটা এবং সর্বাধিক ৩০ভাগই মুক্তিযোদ্ধাকোটা। ০৩ অক্টোবর, ২০১৮ তারিখে মন্ত্রীসভার বৈঠকে শুধুমাত্র প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকুরিতে কোটা বাতিলের বিষয় অনুমোদন হয়েছে। এছাড়া সবক্ষেত্রে কোটা বহাল রয়েছে। এতেই মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীরা প্রশাসনের সাহায্যে আন্দোলন শুরু করেছেন। দেশ অচলের হুমকি দিচ্ছেন। আবার বঙ্গবন্ধুর প্রতি কোটা চালুর অপবাদ দিচ্ছেন। অথচ ওরা ভালভাবেই জানেন, বঙ্গবন্ধুর সময়ে মুক্তিযোদ্ধা ভাতা ও কোটার অস্তিত্ব ছিলনা। তখন মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়ও ছিলনা। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর স্বার্থান্বেষী রাজনীতিবিদগণ তাঁর আদর্শ বর্জন করে সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙ্গালির পরিবর্তে নিজেদের পছন্দমত ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত করেছেন। তালিকাভুক্তদের জন্য ভাতা ও তাদের সন্তান-সন্ততির জন্য কোটা চালু করেছেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় করেছেন। এতে জাতীয় সংসদ থেকে বাজেট বরাদ্দ দিয়ে কোটাভোগীদের রাজনৈতিক হাতিয়ারে ব্যবহার করেছেন। প্রতিটি ভোটকেন্দ্রের অধীনে কমপক্ষে ৪/৫টি পরিবারকে মুক্তিযোদ্ধা কোটাসুবিধা দিয়ে জোরপূর্বক ভোটকেন্দ্র দখলের পায়তারা করেছেন। বর্তমান সরকারও স্বাধীনতার পর এযাবত দেশের সকল চাকুরি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে ৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটা পরিপালনে যেটুকু ব্যাত্যয় ঘটেছে, তা পুরণ করেছেন। যেমন, কোনো প্রতিষ্ঠানে এযাবত ১০০০ নিয়োগ হয়েছে। তাতে ৩০ভাগ মুক্তিযোদ্ধাকোটায় ৩০০জন নিয়োগের কথা। হয়তো ১০০পদে ব্যাত্যয় ঘটেছে। উক্ত প্রতিষ্ঠানে আরো ১০০পদ খালি হলে, তাতে মুক্তিযোদ্ধাকোটায় ৩০পদ ও ব্যাত্যয়ঘটিত ১০০পদ মিলে সম্পুর্ণ নিয়োগপ্রক্রিয়া শুধু মুক্তিযোদ্ধাকোটায় সম্পন্ন করেছেন। এভাবে মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীগণ দেশের সকল প্রতিষ্ঠানে প্রাধান্য লাভ করেছেন। মাত্র ২লাখ তালিকাভুক্ত পরিবার থেকে কোটাভোগীর সংখ্যা প্রায় ২০লাখ অতিক্রম করেছেন। ওরা এ সুবিধা সামান্যও ছাড়তে পারছেননা। সরকারের সাথে আতাঁত করে প্রশাসনের সাহায্যে কোটা বহালের দাবিতে দেশ অচলের হুমকি দিচ্ছেন।

বাংলাদেশের আপামর জনতা মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীদের প্রবঞ্চণা বুঝে গেছেন। ওরা বঙ্গবন্ধুর প্রতিও অবৈধ কোটা চালুর অপবাদ দিয়েছেন। অথচ বঙ্গবন্ধুর সকল ভাষণ ও কর্মকান্ডে কোথাও মুক্তিযোদ্ধাকোটার প্রমাণ নেই। বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির জন্য শুধুমাত্র ৬৭৬ যোদ্ধাকে তালিকাভুক্ত করেছেন। এতে ৩০লাখ শহীদ থেকে ৭জনকে বীরশ্রেষ্ঠ এবং অবশিষ্ট সকল যোদ্ধা, বন্দী, আত্মত্যাগী ও সহযোগী থেকে ৬৬৯ জনকে (বীর উত্তম, বীর বিক্রম ও বীর প্রতিক) খেতাব প্রদান করেছেন। এছাড়া ৩০লাখ শহীদ ও অগণিত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকাও তিনি করেননি। তাদের জন্য ভাতা ও কোটা চালুর প্রশ্নই আসেনা। বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ এর সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালি সবাইকে মুক্তিযোদ্ধা ও শহীদ পরিবারভুক্ত করেছেন। এতোদিন বাংলাদেশের মানুষ স্বার্থান্বেষী ও স্বৈরাচার রাজনীতিবিদদের কারণে নিরব ছিলেন। সম্প্রতি কতিপয় শিক্ষার্থী কোটাসংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমে দেশবাসীকে সচেতন করেছেন। এতেই সরকার কৌশলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের নিরব রাখতে রাতারাতি প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর চাকুরিতে কোটা বাতিলের প্রজ্ঞাপন দিয়েছেন। এখন মুক্তিযোদ্ধা কোটাভোগীরা বেশি বাড়াবাড়ি করলে, দেশের সচেতন জনতার গর্জনে তারা অন্য চাকুরিতেও কোটাসুবিধা হারাবেন এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী হিসেবে লান্থিত হবেন।

সেদিন বেশি দূরে নয়। দেশবাসী বাঙ্গালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনায় উজ্জীবিত হবে। তখন প্রচলিত ২লাখ মুক্তিযোদ্ধা তালিকা, প্রদত্ত ভাতা ও কোটাসবিধা সম্পুর্ণ অবৈধ এবং বঙ্গবন্ধুর আদর্শবিরোধী হিসেবে বাতিল হবে। দেশের সকল নাগরিক বীর মুক্তিযোদ্ধা, লাখো শহীদ ও বঙ্গবন্ধু প্রজন্ম বিবেচিত হবে। সর্বোচ্চ ৩ভাগ করে জেলা, নারী ও ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠি কোটা এবং ১ভাগ প্রতিবন্ধী কোটাসহ মোট ১০ভাগ কোটা বাদে সকল চাকুরিতে কোটা বাতিল হবে। চাকুরি ক্ষেত্রে বয়সের সীমাবদ্ধতা তুলে সবাই দেশসেবায় আত্মনিয়োগ করবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *