এস.বি-সুজন, লালমনিরহাট প্রতিনিধি :

লালমনিরহাট জেলা পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা পুলিশের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে নতুন প্রজন্মের মাঝে ছড়িয়ে দিতে লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা থানার প্রাচীনকালের পরিত্যক্ত পাকা ভবনে গড়ে তুললেছেন ‘বাংলাদেশ পুলিশ জাদুঘর’। যা বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ জাদুঘর হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে।

১৯১৬ সালে নির্মিত পরিত্যক্ত ভবনটি ঐতিহাসিক দালানকে জাদুঘরে রূপান্তরের উদ্যোগ নিয়েছেন লালমনিরহাট জেলা পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা। আগামী ২২ জুন জাদুঘরটি উদ্বোধন করার কথা রয়েছে। যেখানে উপস্থিত থাকবেন পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ।

২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি এই জেলায় প্রথম নারী এসপি হিসেবে যোগ দেন আবিদা সুলতানা। এরপর তিনি জেলার পাঁচটি থানা ঘুরে দেখেন। হাতীবান্ধা থানায় গিয়ে চোখে পড়ে প্রাচীন থানা ভবনটি। তখন না ভেঙে বা নিলামে না তুলে কীভাবে ভবনটিকে ঐতিহ্য হিসেবে রক্ষা করা যায়, তা নিয়ে শুরু হয় তার সুদূরপ্রসারী ভাবনাচিন্তা।

আবিদা সুলতানা ঢাকার বাংলাদেশ পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠা কমিটির সদস্যসচিব ছিলেন। ২০১২ সাল থেকে এ কাজের সঙ্গে যুক্ত হন। পরে ২০১৭ সালে জাদুঘরের পরিচালকের দায়িত্ব পান। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে হাতীবান্ধা থানার পরিত্যক্ত পাকা ভবনে বাংলাদেশ পুলিশ জাদুঘর, লালমনিরহাট স্থাপনের কাজ হাতে নেন। এবং বাংলাদেশ পুলিশ জাদুঘর লালমনিরহাটের কাজ সম্পন্ন করেন।

পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানা জানান, বাংলাদেশ পুলিশ জাদুঘর আগামী ২২ জুন উদ্বোধন করার কথা রয়েছে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদের। ইতিমধ্যে সব প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে জেলা পুলিশ।

তিনি সাংবাদিকদের বলেন, প্রায় দুই বছর এই জেলায় সততার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি। এই জেলায় মাদকসহ নারী অধিকার ফিরিয়ে দিতে মাঠে গিয়ে কাজ করছি। এ জন্য প্রধানমন্ত্রীসহ অনেকের কাছে সম্মান পেয়েছি। এ ছাড়া গত মাসে বাংলাদেশ পুলিশের অতিরিক্ত ডিআইজি পদে পদোন্নতি পেয়েছি। র‌্যাংক ব্যাজ পরিয়েছেন রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি জনাব দেবদাস ভট্টাচার্য।

পুলিশ জাদুঘরের নির্মাণের সিদ্ধান্ত কেন নিলেন, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ব্রিটিশ আমল থেকেই পুলিশের অনেক কৃতিত্ব রয়েছে। নতুন প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা অনেক কিছুই জানে না। তাই থানার পরিত্যক্ত ভবনকে পুলিশ জাদুঘর বানানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছি।

এ ছাড়া বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধকালীন রাজারবাগে প্রথম বুলেট ছুড়েছিল পুলিশ। এরপরই বাংলাদেশে ৯ মাস যুদ্ধের পর আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় পুলিশের ভূমিকা অনেক বড় ছিল। সেসব প্রেরণা থেকে হাতীবান্ধা থানায় বাংলাদেশের প্রথম জাদুঘর নির্মাণ করেছি।

তিনি আরো বলেন, এই লালমনিরহাটের বুড়িমারীর হাসর উদ্দিন বিদ্যালয়ে ৬ নম্বর সেক্টর ছিল। ওই সময়ের এমপি আবেদ আলীর নেতৃত্বে পাটগ্রামের পুলিশ মুক্তি পুলিশ হিসেবে কাজ করেছে। তাই লালমনিরহাটে জাদুঘর নির্মাণ করা অতি জরুরি হয়ে পড়েছিল।

জাদুঘরটি উদ্বোধনের পর সবার জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে। শিক্ষার্থীসহ দেশ-বিদেশের সব দর্শনার্থী ইতিহাস-ঐতিহ্য জানতে এটি দেখতে পারবেন।

যা থাকছে পুলিশ জাদুঘরে বাংলাদেশ পুলিশ জাদুঘর লালমনিরহাটে মোট সাতটি গ্যালারি থাকছে। প্রতিটি গ্যালারিতে রাখা নিদর্শনগুলো দর্শক ও গবেষকদের সামনে তুলে ধরতে কাচের আবরণ ও আলোর ব্যবস্থা করা হয়েছে। এই জাদুঘরে বিভিন্ন সময়ে পুলিশ বাহিনী নানা স্মারক ও তথ্য সবার জন্য উপস্থাপন করা হবে। প্রাচীন এই ভবনের ঐতিহ্যও রক্ষা পাবে জাদুঘরের মাধ্যমে।

এ ছাড়া গ্যালারিগুলোয় সুলতানি ও মোগল আমল, ব্রিটিশ আমল, ভারতীয় উপমহাদেশে পুলিশের উদ্ভব ও ক্রমবিকাশ তুল ধরা হয়েছে। গ্যালারি দুইয়ে থাকছে ব্রিটিশ আমল, আধুনিক পুলিশের যাত্রা। তিন নম্বর গ্যালারিতে রয়েছে স্বাধীনতাযুদ্ধ, ভারতীয় উপমহাদেশ ও বাংলাদেশ স্বাধীনতাযুদ্ধে পুলিশ।

গ্যালারি ৪-এ রয়েছে ডার্করুম ও গ্যালারি। ৫-এ রয়েছে মুক্তাঞ্চলে মুক্তি পুলিশ। মুক্তিযুদ্ধকালে ৬ নম্বর সেক্টরের হেডকোয়ার্টার ছিল লালমনিরহাট জেলার পাটগ্রাম উপজেলার বুড়িমারীতে। সে সময় গঠন করা হয়েছিল মুক্তাঞ্চলের মুক্তি পুলিশ। সেসব কর্মকাণ্ড তুলে ধরাসহ কিছু নিদর্শন থাকছে এই গ্যালারিতে। গ্যালারি ৬-এ আছে বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ, প্রামাণ্যচিত্র প্রদর্শনী। গ্যালারি ৭-এ বাংলাদেশ পুলিশ গ্যালারি, আধুনিক সময়কাল।

এদিকে এক, কলেজশিক্ষার্থী মাহমুদুল ইসলাম সিহাব বলেন, এই জাদুঘরটি নতুন প্রজন্মের কাছে অনেক কিছু পরিচিত করিয়ে দেবে। আমরা প্রাচীনকালে পুলিশের সব কাজকর্ম থেকে শুরু করে ইতিহাস জানতে পারব। বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ জাদুঘর হাতীবান্ধায় হচ্ছে, এটি অনেক বড় বিষয়। তাই বাংলাদেশ পুলিশ ও পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানার প্রতি কৃতজ্ঞ।

বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ডের হাতীবান্ধা উপজেলা আহ্বায়ক রোকোনুজ্জামান সোহেল বলেন, ব্রিটিশ আমলের একটি থানা ভবনে পুলিশ জাদুঘর নির্মাণ সত্যি আমাদের জন্য অনেক গর্বের বিষয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানসহ মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকারের ইতিহাস বিষয়ে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পারবে।

পাটিকাপাড়া ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মুজিবুল আলম সাহাদাৎ বলেন, হাতীবান্ধায় বাংলাদেশের প্রথম পুলিশ জাদুঘর নির্মিত হয়েছে, এটি সত্যি লালমনিরহাটবাসীর জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বড় উপহার। এই জাদুঘর থেকে শিক্ষার্থীরা অনেক কিছু জানতে পারবে। পুলিশ বাহিনীর ইতিহাসের সত্যতা মিলবে এই জাদুঘরে। এটি দেখার সুযোগ করে দেওয়ার জন্য পুলিশ প্রধানকে ধন্যবাদ জানাই।

হাতীবান্ধা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) এরশাদুল আলম বলেন, পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ড. বেনজীর আহমেদ স্যার আসবেন, তাই সব প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে ঘিরে কঠোর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে পুরো উপজেলায়। এ লক্ষ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কে বাড়ানো হয়েছে বাড়তি নিরাপত্তা। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা কঠোর নজরদারি করবেন বলেও তিনি জানান।

আবিদা সুলতানার জন্ম ১৯৭৩ সালে গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলার ঠেঙ্গারবাদ গ্রামে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যন্ত পড়াশোনা ও বেড়ে ওঠা গ্রামেই। তিনি ভারতেশ্বরী হোমস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেন।

তিনি ২২তম বিসিএসে উত্তীর্ণ হয়ে ২০০৩ সালে বাংলাদেশ পুলিশে যোগদান করেন। পেশাগত জীবনে রাষ্ট্রপতির পুলিশ পদকসহ নানা পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *