লেখক -রাধা রানী বিশ্বাস

শুকনো কাঁঠাল পাতা পায়ে দলে হেঁটে যাচ্ছে পূর্ণতা মল্লিক । পাতাগুলোয় মচমচ শব্দ হচ্ছে । একবার ডান পা, আবার বাম পা, এভাবে পাতাগুলো পায়ের তলায় পিষে পিষে আগাচ্ছে ।
রাস্তার পাশে অদূরে লক্ষ্য করল, অজানা গাছে কচি পাতা হালকা বায়ে দুলছে । দুটো পাতা ছিঁড়ে মুখে চিবুলে উদ্ভট গন্ধ নাকে লাগল। জিহ্বাটা কেমন ঝাল লাগছে । মায়ের সাথে রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় মা প্রায়ই বলেন,
“গাছে হাত দিবি না।” তাহলে কি মা জানেন! কোন গাছের পাতায় কেমন স্বাদ!
আবার হাঁটতে শুরু করল পূর্ণতা । কোথায় যাচ্ছে জানে না। মা আর কাকিমার ঝগড়া শুনে মনটা খারাপ লাগছে। মা কাকিমা ঝগড়া লাগলে তার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠে। কেন এমন করে বুকটা?

আম গাছের নিচে এসে থমকে দাঁড়াল। এবার পাতাগুলো অন্য রকম শব্দ হচ্ছে । তার চোখে মুখে এমন একটা ভাব, যেন নিউটনের মত বিরাট কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে । ভাবছে, ” আজব তো! সব শুকনো পাতা একরকম শব্দ কেন হয় না!”
দাঁড়িয়ে চিন্তা করছে।

হঠাৎ পূর্ণতা…..পূর্ণতা…..এই পূর্ণতা…………..বলে ডাকছে, তার ছোট কাকার মেয়ে বিনিতা মল্লিক ।
পূর্ণতা ফিরে তাকাতেই বলল, ” কিরে কোথায় যাচ্ছিস? আজ হিজল গাছের কুড়ি আনব। তুই নারিকেল এর আচায় কুচকুচ করে কেটে রাখবি। দেখবি কেমন সুন্দর হয়। দুজনে রান্না-বাটি খেলব। ”

পূর্ণতা মুখ ভার করে দাঁড়িয়ে আছে । বিনিতা জিজ্ঞেস করল, ” কিরে তুই কথা বলছিস না কেন? ”
এবার পূর্ণতা মুখ খুলল, ” তোর মা আর আমার মা অনেক ঝগড়া করছে । মা বলেছেন আমি যাতে তোর সাথে কথা না বলি। কাকিমা তোকেও বারণ করবে, তুই বাড়ি গেলে। ”

বিনিতার এবার খুব মন খারাপ হল। বলল,
“ভেবেছিলাম আজ খেলব আর বিকালে আমের গুটি কুড়াব। ” দুজন কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল ।

পূর্ণতা আর বিনিতা দুজন এক বয়সী।
নয় থেকে দশ বছরের বেশি নয় । তবুও তারা বোঝে, মা কাকিমা অযথা স্নায়ু যুদ্ধ করেন। আর তাদের বাজি ধরেন, ” তোর মেয়ে যেন আমার মেয়ের কাছে না ঘেষে। ”

পূর্ণতা আর বিনিতা দুজনেই বলে, ” তোর আর আমার মা যদি একজন হত! তাহলে ভালো হত।
এমন ঝগড়া হত না। থাক ! আমরা বাড়ি থেকে বের হয়ে, স্কুলে যাওয়ার সময় কথা বলব। ”

পূর্ণতার মনের মধ্যে কথাগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে ।
সে বাড়ি এসে বারান্দার কাঠের খুঁটিতে, হেলান দিয়ে বসে আছে । তার মা এখনো বকবক করে যাচ্ছেন । আর রাগে রাগে চুলায় শুকনো বাঁশের কঞ্চি ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে । চুলার উপর কড়াইয়ে টগবগ করে মাছের ঝোল বলকাচ্ছে। নামাতে গিয়ে হাতে গরম লাগায় ওহ্…করে উঠলেন।

পূর্ণতা এবার হিহিহি… করে হাসল। মায়ের ভয়ে নিজে থেকেই চুপ হয়ে গেল।

তার মা একা একা আবার বকবক করে যাচ্ছেন।
ফসলের জমির পাশে গরু বাঁধা নিয়ে ঝগড়া ।
পূর্ণতাদের সাদা গাভীর বাছুরটা বিনিতাদের কচি কচি ডাটাগুলো খেয়েছে। পূর্ণতা মনে মনে বকা দিল, ” তুই ঘাস খাবি এখন ! বড় হয়েছিস! তা নয়! সে গিয়ে কচি কচি ডাটা খেয়েছে ।”
একথা বলেই, উঠোনের পরে পেয়ারা গাছে বাঁধা বাছুরটার কাছে দৌঁড়ে গেল ।

“তুই খুব দুষ্ট ” একথা বলে বাছুরটার থুতনির নিচে হাত বুলিয়ে আদর করল। বাছুরটা থুতনি উঁচু করে দিল আদর নেওয়ার জন্য । পূর্ণতা দুই হাতে গলা জড়িয়ে ধরলো ।

বাছুরটা লেজ দিয়ে গায়ের মাছি তাড়াচ্ছে। লেজ এসে একবার পূর্ণতার গায়ে লাগলে পূর্ণতা খিলখিল করে হেসে উঠলো ।

ওর মা তাকিয়ে দেখেন মেয়ে বাছুরের সাথে কথা বলছে। ঝগড়া করে তার মায়ের রাগ এখনও কমে নাই ।
মেয়েকে গজগজ করে বলল, ” এই দিকে আয় ! বাছুরকে আর সোহাগ করতে হবে না। ” মায়ের ডাকে পূর্ণতা বাধ্য মেয়ের মত চলে এল। তার মা রেগে আছেন,এখন কথা না শুনলে মা তাকে মারবে ।

গায়ত্রী দেবী ময়লা কাপড়ের বালতি নিয়ে কলতলা গেলেন । কল চেপে চেপে জল তুলে বালতি ভরলেন । মেয়েকে না দেখে চিৎকার করে ডাক দিতে যাবেন, এমন সময় পিছনে ফিরে
দেখেন মেয়ে তার পিছনে দাঁড়িয়ে আছে ।

নরম সুরে আদর করে ডাকলেন, ” কাছে আয় গা মেজে স্নান করিয়ে দিই। ”
শীতের ভয়ে মেয়ে যেতে চাইছে না। চলে গেলে মা মারবেন। তাই ঠায় দাঁড়িয়ে আছে । গায়ত্রী দেবী
এবার স্বর উঁচু করে বললেন, ” কি হল? শুনতে পাচ্ছিস না? ” বলেই হাত টান দিয়ে নিয়ে এল।
স্নান শেষে দুই হাত ভাজ করে,বুকের কাছে নিয়ে
কাঁপছে ।

গায়ত্রী দেবী যত্ন করে মেয়ের শরীর মুছে দিলেন।
লক্ষ্য করলেন মেয়ের পুস্প শরীরে কুঁড়ি মেলতে শুরু করেছে । গায়ত্রী দেবী বললেন , ” বিকালে কিন্তু ধুলোবালিতে খেলবি না। আর বিনিতার সাথে বেশি মিশবি না। ”
” তাহলে কার সাথে খেলব মা! তোমার রাগ তো কাকিমার উপর ! আমি কেন যাব না? “মেয়ের কথা শুনে চুপ করে রইলেন গায়ত্রী দেবী ।
পূর্ণতা চলে এল রোদে তেল মাখাবে গায়ে ।
মায়ের কথা সে কানেই নিল না।

খেতে বসে বাবাকে সব বলে দিল,” জান বাবা, মা আর কাকিমা ঝগড়া করছে,আমাদের বাছুরটা বিনিতাদের ক্ষেতের ডাটা খেয়েছে বলে।”

শ্রীনাথ মল্লিক চুপচাপ খাবার খাচ্ছেন। কয়েক মুহূর্ত কেটে গেল তারপর স্ত্রীকে বললেন, ” এত তুচ্ছ বিষয় নিয়ে ঝগড়া করলে কেন? একটু চুপ থাকলেই তো হত । সবে কচি ডাটাগুলো লকলকিয়ে উঠেছে । তাই রাগে নাহয় দুচার কথা বলেছে। ”

গায়ত্রী দেবী চামচ দিয়ে পাতে তরকারি দিচ্ছেন ।
হাতে ইশারা করে না করলেন শ্রীনাথ বাবু, তরকারি না দেওয়ার জন্য। চামচ রেখে গায়ত্রী দেবী বললেন, ” আমাদের লাউ গাছ মাচায় উঠার আগেই তাদের গরু গাছের ডগা গুলো খেয়েছে । আমি তো কিছু বলিনি ।”

মা বাবা কথোপকথনে ব্যস্ত। সুযোগ বুঝে পূর্ণতা বিনিতার সাথে খেলতে চলে গেল। লায়লা, ফাতেমা, মিনু, রীতি আগে থেকেই অপেক্ষা করছিল। ওদের দেখে সে কি হাসি!
” আজ অনেক সময় খেলব। বিনিতা, পূর্ণতা যাবি না কিন্তু। ” লায়লা কথাগুলো বলে খেলার দল গুছাতে লাগলো । কে কোন দলে থাকবে !

পশ্চিম আকাশে সোনালী রঙের মাঝে সূর্য ডুবে যাচ্ছে । পাখিরা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ঘরে ফিরছে। তবুও
তাদের খেলা বন্ধ হয় না। পাশের বাড়ির হাবিব চাচা ধমক দিলেন, ” সন্ধ্যা হয়ে গেছে এখনো তোরা খেলছিস ? বাড়ি যা বলছি! ”

পূর্ণতা চমকে উঠে নিজেকে আবিষ্কার করল জানালায়, হাটু ভাঁজ করে বসে আছে । দীঘল কাল চুল ছাড়া, আঁচলের খানিকটা খাটে পড়ে
আছে। কপালে টিপ,হাতে সোনার চুড়ি, গলায় মোটা চেইন,হীরের আংটি সব মিলিয়ে যেন স্বর্গের অস্পরা লাগছে পূর্ণতাকে। ঘরের দামী আসবাবপত্র বলে দেয় স্বামীর কত টাকা আছে।
দামী প্রসাধনীর স্নিগ্ধ গন্ধ ঘরটাকে মোহনীয় করে রেখেছে।
এত ঐশ্বর্যের মাঝেও তার ছোট ছোট ইচ্ছে গুলো,প্রতিমুহূর্তে মৃত্যু বরণ করে । স্বামী ঘরে ঢুকে ধমকের সুরে বলল, ” আমার তোয়ালে কোথায়? ” তখন পূর্ণতা সম্বিত ফিরে পায়। স্বামীর দিকে তাকিয়ে তাড়াহুড়ো করে চলে যায়, তোয়ালে আর এক গ্লাস জল আনতে ।
(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *