হুমায়ুন কবির সূর্য্য, কুড়িগ্রাম থেকে :
কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের হিসাব রক্ষক আশরাফ মজিদ এখন কোটি কোটি টাকার মালিক। তার বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম দুর্নীতির অভিযোগ উঠলেও কর্তাদের খুশি করে তিনি রয়েছেন ধরাছোঁয়ার বাইরে। তার দৌড়াত্বে অসহায় সাধারণ কর্মচারীরাও। মধ্যবিত্ত এই পরিবারের সন্তানটি এখন গড়েছেন অবৈধ টাকার পাহাড়। সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নে গ্রামের বাড়িতে কিনছেন একের পর এক জমি। বর্তমানে ১৮/২০ লাখ টাকা খরচ করে কিনেছেন ৮০ শতক জমি। এছাড়াও শহরের পৌর এলাকার গস্তি পাড়ায় ৬০ লাখ টাকা ব্যয়ে কিনেছেন দুটি জমি। এর একটিতে প্রায় ২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করছেন ৫ তলা ভবন। এর বাইরেও গড়েছেন অবৈধ সম্পদের পাহাড়।
বর্তমানে কুড়িগ্রাম জেনারেল হাসপাতালটি এখন পরিণত হয়েছে দুর্নীতির স্বর্গ রাজ্যে । প্রতিষ্ঠান না থেকেও ঠিকাদারী কাজ পাইয়ে দেয়া হচ্ছে। সরবারি ঔষধ পাচার হলেও মূল হোতারা থেকে যাচ্ছেন ধরা ছোয়া বাইরে। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সীমাহীন দুর্নীতির কারণে বিনামূল্যে ঔষধসহ কম্বল-মশারি না পেয়ে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে সেবা গ্রহীতাদের।
কুড়িগ্রাম আড়াইশ’ শয্যা বিশিষ্ট জেনারেল হাসপাতালে প্রতিদিন শত-শত রোগী সেবা নিতে আসেন। এদের মধ্যে অনেকেই ভর্তি হন আবার কেউ চলেও যান। ভর্তি হওয়া রোগীদের জন্য সরকারের দেয়া কম্বল, চাদর, বালিশের কভার দেবার নিয়ম থাকলেও সেগুলো সঠিকভাবে দেয়া হয় না। শীতের সময় শয্যা বা মেঝেতেও মিলছেনা কম্বল, বালিশের কভার। যা নোংরা ও দুর্গন্ধযুক্ত। রোগী ভর্তি করে অনেকটাই বাধ্য হয়েই বাড়ি থেকে গড়ম কাপড় আনতে হয় স্বজনদের।
এদিকে অসাধু উপায়ে মানিক লন্ড্রি এবং সাদেক লন্ড্রি নামের দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেয়া হয়েছে কাজ। যাদের কোন প্রাতিষ্ঠানিক কাগজপত্র নেই। এসব লন্ড্রি থেকে প্রতিমাসে মাসোয়ারা ও কাজ না করে বিল তোলার অভিযোগ উঠেছে। আর এর প্রধান হোতা হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আশরাফ মজিদ। এখানে বিলগুলোতে দেখা যায় গড়ম কালেও কম্বল ধৌতের মোটা অংকের বিল তোলা হয়েছে।
হলোখানা ইউনিয়নের এক জনপ্রতিনিধি জানান, আশরাফ মজিদ সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের টাপুরচর গ্রামের অবসর প্রাপ্ত প্রাইমারী শিক্ষক বহিয়ত উল্লাহ মাস্টারের ছেলে। তার পিতার প্রায় ১০বিঘা সম্পত্তি রয়েছে। এই সম্পত্তির অংশীদার রয়েছেন ৬ভাই বোন। তিনি বলেন, তার পরিবারের লোকজনের এত জায়গা-জমি কেনার সামর্থ নেই।
তথ্যানুসন্ধানে দেখা যায় কম্বল-১১টাকা, চাদর-১৭টাকা, বালিশের কভার-৭টাকা, মশারী-৫টাকা, দরজা ও জানালার পর্দা-৪টাকা করে এবং তোয়ালে- ৩টাকা একক দর দেয়া রয়েছে। বিল সীটে দেখা যায় শীত ও গ্রীষ্মকালিন সময়ে প্রতিমাসে গড়ে ঠিকাদার প্রায় দেড় লাখ টাকা করে উত্তোলন করছেন। জেনারেল হাসপাতালের ১০০শয্যা রাজস্ব খাত এবং ১৫০শয্যার জন্য উন্নয়ন খাত থেকে ধৌত বিল প্রদান করা হয় ঠিকাদারকে।
ঠিকাদার মানিক মিয়া বলেন, দু’বছর ধরে হাসপাতালের ধৌত কাজের ঠিকাদারী করছেন। সরেজমিনে দেখা যায় মানিক তার বাড়ির পুকুরে হাসপাতালের কাপড়-চোপড় ধৌত করে রোদে শুকাতে দিয়েছেন। সেখানে কোন কম্বল ছিল না। মানিক লন্ড্রি প্রতিষ্ঠানটি দাদামোড়ে থাকার কথা জানালেও তার ভাই সাদেক জানান, বর্তমানে লন্ড্রি প্রতিষ্ঠান না থাকলেও পূর্বে ছিল। এছাড়াও মানিক আরো জানান, তার এবং তাদের স্বজনের কাছ থেকে ৩ বছর আগে প্রায় ৬০লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনেছেন হিসাবরক্ষক আশরাফ মজিদ।
সরেজমিনে দেখাযায়, শহরের দাদামোড় ঠিকানায় মানিক লন্ড্রি এবং সাদেক লন্ড্রি নামের প্রতিষ্ঠানকে কাজ দেয়া হলেও বাস্তবে এই দুটি প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
দাদামোড়ের লন্ড্রি ব্যবসায়ি সালাম জানান, তিনি ৭/৮ বছর ধরে এখানে লন্ড্রির ব্যবসা করছেন। এখানে এই নামে কোন প্রতিষ্ঠান নেই।
সম্প্রতি ঔষধ পাচারকালে মোসলেমা, রোসনা বেগম নামে দুজন মহিলাকে পুলিশ আটকের ঘটনায় নাম প্রকাশ না করার শর্তে হাসপাতালের এক কর্মকর্তা, সিনিয়র নার্স জানান, হাসপাতালের ওয়ার্ড ইনচার্জ অনেকেই আছেন দীর্ঘদিন ধরে এই পদটি ধরে আছেন। তারা রোগীদের সরকারি ঔষধ না দিয়ে বাইরে থেকে কিনে নিয়ে আসতে বলেন। আর এই ঔষধগুলো বিতরণ দেখিয়ে বহিরাগত নারী-পুরুষদের দিয়ে সরকারি ঔষধ পাচার করেন। কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে একটি চক্র নিয়মতি ঔষধ পাচার করার অভিযোগ করেন তারা।
এছাড়াও হাসপাতালের প্রধান সহকারি ইউনুস আলীর বিরুদ্ধে নভেম্বর মাসে ৯০জন নার্স হাসপাতালে যোগদান কালে তাদের নিকট হতে জনপ্রতি ১ হাজার টাকা করে নেবার অভিযোগ রয়েছে।
হাসপাতালের হিসাবরক্ষক আশরাফ মজিদের কাছে অনিয়মের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপনি আমাকে চেনেন। আমার সম্পর্কে জানেন। আপনাকে তথ্য দিতে আমি বাধ্য নই। জেলার চারশ’ সাংবাদিকের সাথে আমার পরিচয় আছে বলে দাম্ভিকতা প্রকাশ করেন তিনি। এক পর্যায় তিনি বলেন বেসরকারি ন্যাশনাল ব্যাংক হতে ২৩ লাখ টাকা ঋণ নিয়েছেন।
হাসপাতালের ত্বত্তবধায়ক ডা: আনোয়ারুল হক প্রামাণিক জানান, ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানকে নিয়ম মাফিক কাজ দেয়া হয়েছে। ধৌত না করেও নিয়মিত বিল উত্তোলন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এই বিলগুলো চেক করেই আমার কাছে আসে সে হিসেবেই আমি বিলের কাগজে সই করে থাকি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *