কলমে- রাধা রানী বিশ্বাস 

————————————————-

পিঞ্জর বাড়ি থেকে চলে যাওয়ায় পিঞ্জরের মা সুমতি দেবীর সব কাজে কেমন অনীহা লাগে। 

খেতে বসলে তার ছেলের জন্য কষ্ট হয় তখন আর খেতে ইচ্ছে করে না। মা ছেলে খাওয়ার সময় কত গল্প করত আর খেত। এখন যা রান্না করে বেশির ভাগ হাড়িতে জমে থাকে। একা একা খেতে তার একদম ভালো লাগে না। 

স্বামীর পেনশনের টাকা ছেলেকে পাঠিয়ে যা থাকে তাই দিয়ে চলতে কষ্ট হয়। কিছু টাকা চাষাবাদের পিছনে খরচ হয়। কৃষাণ, সার,জল কিনতে হয়। পিঞ্জর ফোন করে সব জানতে চায়।

কিন্তু ছেলেকে তিনি কিছুই বলেন না। শুধু মনযোগ দিয়ে পড়ালেখা করতে বলেন।

পিঞ্জরের বাবা বেঁচে থাকতেই পাশের বাড়ির লালু মাতবর অনেক জ্বালিয়েছেন। স্বামী মরার পরে সুমতি দেবীকে কুপ্রস্তাবও দিয়েছিলেন। সুমতি দেবী বটি

হাতে তেড়ে গিয়ে শাসিয়েছেন। লালুর বউকে বলেছেন, ” তোমার স্বামী যদি আর কোন দিন আমার উঠোনে পা রাখেন তাহলে তাকে এই বটি দিয়ে টুকরো করে ফেলবো। “

এই কথা শুনে লালু আর সাহস পায়নি। ছেলে-মেয়ে আর বউয়ের চাপে কোন দিন সুমতি দেবীকে কিছু বলেননি। কিন্তু সব সময় জ্বালিয়েছেন। বাড়ির সীমানা ঘেষে ফসলের জমি থেকে কিছু ফসল কেটে নিয়ে যেত, ইচ্ছে করে গরু ছেড়ে দিত পাকা ফসলে, ধান ক্ষেতের আইলের নিচে কুপিয়ে মাটি সরিয়ে রাখত যাতে ক্ষেতের জল তার ক্ষেতে নেমে আসে আরও কতোকি । পিঞ্জর বড় হওয়ার পর থেকে এগুলো কমেছে। 

এখন অনেক বয়স হয়েছে লালুর। চুল সব সাদা হয়েছে, গায়ের চামড়া কুঁচকে গেছে। চোখে এখন কাল ফ্রেমের মোটা চশমা।সামনের দিকে একটু বাঁকা হয়ে হাটে, কথা বলতে গেলে গলার স্বর কাঁপে। তবুও স্বভাব পরিবর্তন হয়নি।

রাতের অন্ধকারে নিজের বাড়ির বিশ্বস্ত কৃষাণকে দিয়ে পিঞ্জরদের পুকুরের জলে বিষ মিশিয়ে দিয়েছেন। সকালে সব মাছ মরে পুকুরের জলে ভেসে উঠেছে। পিঞ্জরের প্রতিবেশী ঠাকুমা ঘাটে জল নিতে এসে এহেন কান্ড দেখেন। উচ্চ স্বরে পিঞ্জরের মাকে ডাকে,”ও.. সুমতি! কোথায় গেলি? বাড়ি আছিস? শিগগির আয়!”

ডাক শুনে শাড়ির আঁচল ঠিক করতে করতে ঘরের বাইরে এল সুমতি দেবী। বললো,”কি হয়েছে কাকিমা? তোমার চোখ মুখ এমন দেখাচ্ছে কেন?” পিঞ্জরের মায়ের চোখে উদ্বিগ্নতা,”ঢাকার কোন খবর নাকি? আমার পিঞ্জরের কিছু হয়েছে? “

 পিঞ্জরের প্রতিবেশী ঠাকুরমা বিধুবালা রায় বয়সের ভারে গলা কেঁপে কেঁপে বলল,” তোদের পুকুরের মাছ সব ভেসে উঠেছে। “

একথা শুনে সুমতি দেবী এক রকম দৌঁড়ানোর মত করে হেঁটে ছুটে গেল পুকুর পাড়। তার মাথার উপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। অনেকক্ষন বসে 

কান্না করল। পিঞ্জর পুকুরে মাছের পোনা

ছেড়ে দিয়ে বলেছিল,” মা তুমি পুকুর থেকে মাছ তুলে খাবে। আর বেশি বড় হলে বিক্রি করে আবার পোনা কিনে ছাড়বে। তবে কৃষাণ নিও। একা একা এসব কাজ করতে যেও না। “

সুমতি দেবী বারান্দায় গালে হাত দিয়ে বসে আছেন। পাড়ার কিছু উৎসুক মহিলা উঠোনে দাড়িয়ে আছে। 

লালু পিঞ্জরদের উঠোনের পাশে, যেখানে দুধের গাভি দুটো দাঁড়িয়ে পান চিবানোর মত খড় চিবাচ্ছে। সেখানে দাঁড়িয়ে কাশি দিয়ে বলল, “পিঞ্জরের মা…বাড়ি আছো? আমায় একটা পান সাজিয়ে দিবি মা?”

 উঠানে দাঁড়ানো মহিলারা সমস্বরে বলে উঠলো, “কাকিমার মন খারাপ। পুকুরের মাছ সব মরে গেছে।” 

মুলত লালু পর্যবেক্ষণ করতে এসেছে পুরো বিষয়টা। সুমতি দেবী কোন কথা বললেন না। 

কারণ সে এটা জানে লালু এসেছে কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা দিতে।

সুমতি দেবীকে নিরুত্তর দেখে লালু হাতের লাঠি টা খটখট শব্দ করে বের হয়ে গেল। লালু মনে মনে তৃপ্ত হল, পুরনো ঘটনার প্রতিশোধ স্পৃহার আগুন একটু হলেও নিভাতে পেরেছেন। 

পিঞ্জর নীলক্ষেত গিয়েছে বই,কাগজ কলম কিনতে। ওখানে সব কিছু এক জায়গায় পাওয়া যায় আবার দামও একটু সস্তা। বই কিনে গলি

দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময়। তার দূর সম্পর্কীয় এক দাদা শিমুল এর সাথে দেখা।শিমুলের” কিরে পিঞ্জর? কেমন আছিস? “বলতেই ঘুরে দাঁড়াল সে।

” কেমন আছ দাদা? আমি ভাল আছি ।” তার মা কেমন আছেন জানতে চাইল।

শিমুল মুখের ভাবভঙ্গি দেখে বুঝতে পেরেছে পিঞ্জর বাড়ির ঘটনা জানে না।

“কাকিমার সাথে তোর কবে কথা হয়েছে?”জানতে চাইল শিমুল। 

“কেন দাদা কি হয়েছে? মা গতকালও আমার সাথে কথা বলেছেন। মা বললেন সামনে পরীক্ষা। তাই কথা বলতে চাইলেন না।”

শিমুল কাঁধে হাত দিয়ে বলল, “পিঞ্জর তোর পুকুরের মাছ কে যেন জলে বিষ দিয়ে মেরে ফেলেছে।” 

পিঞ্জর স্তব্ধ হয়ে কথা শুনলো।কিছু বলল না। শিমুল পিঞ্জরকে ভালো করে পড়ালেখা করতে বলে চলে গেল। আর বলল “সময় পেলে বাড়ি যাস,দেখা করিস।” পিঞ্জরের আশা গুলো স্তুপ করা বালি নাড়া দিলে যেমন করে ঝরে পড়ে,

ঠিক তেমন করে ঝরে যাচ্ছে। চোখের জল ধরে রাখতে পারল না। পকেট থেকে টিস্যু পেপার বের করে চোখ মুছে হাঁটতে লাগল।

মা তাকে বলল না! মা একা একা কষ্ট পাচ্ছে! 

পিঞ্জর তার মাকে ফোন দিল না।সিদ্ধান্ত নিল বৃহস্পতিবার ক্লাস শেষ করে বাড়ি যাবে। মাকে দেখে আসবে। যেই কথা সেই কাজ। 

সুমতি দেবী ভাত রান্না করেছে সন্ধ্যার আগে।

ঘরের দুয়ার বন্ধ করে খাটে বালিশ হেলান দিয়ে চুপ করে বসে আছেন। খেতে মন চাইছে না।

গোয়াল ঘরের পাশে কাঠের বেড়াটা

কর…কররর শব্দ হল। সুমতি দেবী একটু ভয় পেয়ে কান সজাগ করে আছেন। 

পিঞ্জর কাঠের বেড়াটা ঠেলে সোজা রাস্তায় উঠোনে এসে ব্যাগটা রেখে দাঁড়াল। মাকে দেখতে না পেয়ে ডাকল, “মা..,ও মা……। “ছেলের ডাক কানে যেতেই সুমতি দেবী তড়িঘড়ি করে ঘর থেকে বের হল। ছেলেকে জড়িয়ে ধরে বললো,”কেমন আছিস বাবা?”

আবেগে চোখের জল বাঁধ মানল না। আঁচলে চোখ মুছে বলল “ঘরে চল।” পিঞ্জর উপুর হয়ে মাকে প্রণাম করল।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *