আব্দুল খালেক ফারুক
দুই
তীব্র গরমে তিন কিলোমিটার পথ হেঁটে হাফিয়ে উঠেছে ইতু। পাড়ার মোড়ে পৌঁছে গেলেন এক সময়। এখানে রমজান ভান্ডারির দোকান। এক সময় দোকানের সাউন্ড বকে্্র প্রচুর মাইজভান্ডারি গান বাজতো। ‘খাজা বাবা, খাজা বাবা, মারহাবা মারহাবা’ টাইপের। পাড়ার ছেলেরা তাই তার নাম দিয়েছে ‘ভান্ডারি!’ রমজান ভাই আপত্তি করেননি। সেই থেকে রমজান ভান্ডারি।
এখন রমজান ভান্ডারির দোকানে কাস্টমারের ভিড় নেই। দোকানের সামনের বেঞ্চে খালি গায়ে বসে আছেন রমজান। দশাসই ভঁুড়িখানা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। হাতে একটি স্মার্ট ফোন। রমজান ভাই ফোনটি হাতে নিয়ে একাগ্রচিত্তে কী যেন দেখছেন। আর স্ক্রিনে আঙুল দিয়ে উপরের দিকে ঠেলছেন।
‘রমজান ভাই, খবর কী?’
‘অনেক খবর আছে। কয়টা শুনবা? মাদ্রাসার শিক্ষক আসলাম মন্ডলের নামতো শুনছো।’
‘হ্যাঁ, শুনেছি। তো কী হয়েছে?’
‘উনি তৃতীয় বিবাহ করছে। ফেসবুকে ওনার নয়া বিবির ছবি দেখতাছি। মারহাবা।’
এই হচ্ছে রমজান আলী ভান্ডারি। তার কাছে কোন খবর গোপন থাকেনা। আর যে কোন খবর পেলে দ্রুত রিলে করে দেন।
রমজান ভান্ডারির দোকানের পাশেই একটি রেস্টুরেন্ট। বিরাট আকারের সাইবোর্ড। হোটেলের নাম ‘খানা হালাল হোটেল এন্ড রেস্টুরেন্ট।’ সাইনবোর্ডে বেশ বড় করে লেখা ‘এখানে পাকিস্তানি মুরগী পাওয়া যায়’।
রেস্টুরেন্টের মালিক ইসলাম মিয়া একজন মুক্তিযোদ্ধা। তিনি সব সময় ৩ জন খান সেনাকে খতম করার বহুল প্রচলিত গল্পটা সবাইকে শোনান। সেটা মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনা। এখন খানরা নেই। কিন্তু সুযোগ পেলে তিনি পাকিদের উপর ঝাল ঝাড়তে কসুর করেন না। তাই সবাই পাকিস্তানি মুরগীকে দেশি মুরগী বলে চালালেও ইসলাম মিয়া তা করেন না। তিনি সগর্বে পাকিস্তানি মুরগী জবাই করে কাস্টমারদের খাওয়াতে ভালবাসেন। সাইনবোর্ডে তিনি বিরাট মুরগীর ছবিসহ সে কথা জানান দিয়েছেন।
খানা হালাল রেস্টুরেন্টের মালিক ইসলাম মিয়া এখন ক্যাশে আছেন। ম্যানেজার জানে আলমকে দেখা যাচ্ছেনা। হয়তো হোটেলের মালামাল কিনতে গেছেন। ওখানে নিশ্চয়ই কিছু হাত সাফাই হবে। ম্যানেজারের হাত সাফাইয়ের অভ্যাসটা পুরোনো।
ম্যানেজার ইতুকে বাকী দিতে চায়না। হোটেলের বাকীর টালিখাতায় ইতুর নামে একটা হিসাব খোলা আছে। দীর্ঘদিন ধরে কোন পেমেন্ট দিতে পারছেন না। তাই ম্যানেজার তার উপর বেজায় নাখোশ। ইতুকে দেখলে তার গায়ে ১০৫ ডিগ্রি জ¦র আসে। তার বিরক্তির অন্য কারণও আছে।
এই ম্যানেজার বিরাট বদ প্রকৃতির। রাতে কারেন্ট গেলে ওনার কেরামতি শুরু হয়। মুহূর্তে ক্যাশের টাকা সরিয়ে পকেটে চালান করেন। আজকাল কারেন্ট যায় ঘন ঘন। আর ম্যানেজারের পকেটভারী হয়। একদিন ক্যাশের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ইতু। হঠাৎ কারেন্ট গেল। ম্যানেজার টাকা সরিয়ে পকেটে রাখছেন। এ সময় হুট করে কারেন্ট চলে এলো। ইতু দেখে ফেললেন সেই দৃশ্য। তারপর চোখাচোখি। ম্যানেজার মুহূর্তে মাটির মানুষ হয়ে গেলেন।
‘এয় ইতু ভাইয়ের বিল কতো?’
‘৩০ টাকা।’
‘ভাই যান, টাকা দিতে হবে না।’
‘ক্যান—দিতে হবে না ক্যান? আজকাল ফ্রি সার্ভিস চালু হয়েছে নাকি?’
‘না—মানে আপনি বেকার মানুষ। সব সময়তো টাকা পয়সা থাকেনা। চিন্তা করবেন না। টাকা না থাকলে খাতায় লিখে রাখবো। পরে দিবেন।’
ইতু চোখ ছোট করে এক রহস্যময় হাসি দিয়ে ম্যানেজারকে ভড়কে দেয়ার চেষ্টা করলো।
এভাবেই বাকীর খাতার যাত্রা শুরু। জানে আলমের অসততার কথা মালিক ইসলাম মিয়াকে বললে হয়তো আজই চাকুরি নট হবে। কিন্তু বেকারের বাকির কাছে বিবেক অনেকটা বন্ধক।
‘এই ভাতিজা দোকানে আসো।’ মালিক ইসলাম মিয়া তাকে উচ্চস্বরে ডাকছেন। আর হাত ইশারাও করছেন। মনে হচ্ছে জরুরি বিষয়। ডাবল তলব দেখে তাই মনে হচ্ছে।
‘চাচা বলেন। হঠাৎ ডাকলেন কেন? দুপুর বেলায় হোটেলে ঢুকলে ক্ষুধা আরো বেশি লাগে।’
‘এইডা একটা কথা বললা তুমি। ক্ষুধা লাগলে খাবা। খাবার জন্যইতো হোটেলটা দিছি। ’
‘তা ঠিক। তবে পকেটের স্বাস্থ্য খারাপ।’
‘এই যে— কী কয় বেটা। আরে পয়সা না থাকলে পরে দিও। চাকুরি হইলে দিও।’
‘চাকুরি মনে হয় হবে না চাচা। আপনার মতো কোটা থাকলে একটা কথা ছিলো।’
‘ভালো কথা বলছো। কষ্ট কইর‌্যা দ্যাশটা স্বাধীন করছিনা? কিছু ফলতো ভোগ করুম। চা খাও। এয় মনছুর, পাতি মাইর‌্যা ভাতিজারে এক কাপ চা দাও।’
লেবু চায়ে একটা আয়েশী চুমুক দিয়ে মুক্তিযোদ্ধা ইসলাম মিয়ার দিকে তাকায় ইতু। একটা সুখী সুখী ভাব। মাথায় ঝাকরা চুল। অবাধ্য চুলগুলোকে শাসনে রাখতে জাতীয় পতাকার পট্রি দিয়ে বেঁধে ফেলেছেন। হাতে ব্রেসলেট। বুড়ো বয়সেও বেশ সৌখিন আছেন এখনো। গায়ে আতরের ভুর ভুর গন্ধ। গুণ গুণ করে সুর ভাজেন। মনে হচ্ছে সামসাদ বেগমের কোন গান। মুখে মসলা পানের ঘ্রাণ। নারকেল আর মসলা দিয়ে বানানো একটা স্পেশাল ডাবল পান মুখে চালান করে ইতুর দিকে একটু সরে এলেন ইসলাম মিয়া। কিছু বলতে চান। তবে গলার স্বরটা একটু নিচু। কিছুটা ভাঙা ভাঙা।
‘বাবাজী শুনলাম কোটা তুইল্যা দিচ্ছে সরকার। তুমি কোন খবর জানো। তোমরা শিক্ষিত ছেলে। খবরাখবর বেশী থাকে তোমাদের কাছে।’
‘আপনি এতো চিন্তা করেন ক্যান। আপনার সব ছেলেমেয়ের তো চাকুরি হয়েছে। এখন কোটা থাকলো না গেল তা নিয়ে এতো চিন্তা ক্যান?
‘এইযে বোকার মতো কথা কও। ছোট ছেলেটাতো কেবল রিটেন দিলো। ভাইভা বাকী। এখনও বলা যায় না কী হবে। আর শুধু কোটায় চাকুরি হইছে— এইডা ভাইবো না। খরচাপাতি না করলে কপাল চাপড়াইয়া কোন ফায়দা হইতো না।’
‘ভালো। আপনাদের ছেলে—মেয়ের লাইন শেষ না হলে তো আমাদের কোন চান্সই নাই। অনেক মুক্তিযোদ্ধা দ্বিতীয় বিবাহ করেছেন। দ্বিতীয় পক্ষের ঘরে সন্তান—সন্ততিরাও চাকুরি প্রার্থী। তাই লাইনটা শেষ হচ্ছেনা।’
মোসলেম মিয়া দ্বিতীয় বিবাহ করায় ইতু বুঝে শুনে কথাটি বললো। তবে তিনি না বোঝার ভান করে তাঁর বাতচিৎ জারি রাখলেন।
‘ছেলে মেয়ে শ্যাষ হইলে কী হইবো? নাতি—নাতনি আছেনা? তাদের একটা গতি কইর‌্যা না যাইতে পারলে কবরে গিয়া শান্তি পামু? পরওয়ারদিগারকে কী জবাব দিমু কও? যা দিনকাল পড়ছে।’
‘আপনার আশা মনে হয় পূরণ হবে না চাচা। প্রধানমন্ত্রীর জবান বলে কথা। তিনি পরিস্কার বলে দিয়েছেন— কোটা থাকবেনা।’
ইতুর এ কথা শুনে খুক খুক করে কাশতে লাগলেন ইসলাম মিয়া। মনে হয় মশলা পান বাগড়া দিয়েছে। এখন শ^াসযন্ত্রে গিয়ে ঘোট পাকাচ্ছে। জবান বন্ধ হয়ে গেছে তার। ইশারায় পানি আনতে বলছেন। কিন্ত এই ঘোরতর বিপদের সময় বয়—বেয়ারারা কেউ দেখছেন না। অবস্থা বেগতিক দেখে ইতু দৌড়ে গিয়ে টেবিল থেকে এক গ্লাস পানি এনে ইসলাম মিয়ার হাতে দেন। দ্রুত গলায় ঢেলে মনে হয় একটা স্বস্তি পান তিনি। দুচোখে অশ্রম্ন ঝরছে। ইতুর দিকে ক্ষাণিক তাকিয়ে থাকেন। গলায় তখনও কথা ফোটেনি। ইতু এই সুযোগে নি:শব্দে বের হয়ে আসেন খানা হালাল হোটেল থেকে।

****রচয়িতা-একজন স্বনাম ধন্য লেখক,কবি ও সিনিয়র সাংবাদিক****

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *