এস. কে সাহেদ, লালমনিরহাট

জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে না পারায় যাবজ্জীবন কারাভোগের পর গত বছরের ৪ ডিসেম্বর থেকে আরো তিন বছরের জন্য কারাভোগ করছিলেন রেখা খাতুন । পরে বেসরকারি কারা পরিদর্শক টিমের সদস্য কবি ও সমাজসেবী ফেরদৌসী বেগম বিউটির সহযোগিতায় জরিমানার একলাখ পরিশোধ করা হলে ঈদের একদিন আগে ৯ এপ্রিল ছাড়া পায় রেখা খাতুন।
এরআগে রেখা খাতুনের জীবন-গল্প শোনে সমাজসেবী কবি ফেরদৌসী বেগম বিউটি, লালমনিরহাট জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ উল্ল্যাহ ও পৌর মেয়র রেজাউল করিম মিলে জরিমানার টাকা পরিশোধ করেন।
এদিকে জেল থেকে বের হয়ে রেখা বেগম দেখেন তার বাবা-মা ও ভাই-বোনসহ ২৫জন আপনজন মারা গেছেন। স্বামী আবার বিয়ে করে নিরুদ্দেশ। এখন তার আর মাথা গোজার ঠাঁই নেই। এমন খবর শোনে জেল গেটের সামনেই কান্নায় ভেঙে পড়েন রেখা খাতুন (৪৩)। রেখার বাবার বাড়ি লালমনিরহাট সদর উপজেলার বড়বাড়ী ইউনিয়নের কলাখাওয়া ঘাট নামক এলাকায়।
তার বাবা ফজলু রহমান মারা গেছেন ১৫ বছর আগে আর মা নুরনাহার বেগম মারা গেছেন ১২ বছর আগে। নদী ভাঙনে অনেক আগেই হারিয়ে গেছে বসতভিটা। প্রায় বিশ বছর আগে স্বামী কোরবান আলীও আরেকবার বিয়ে করে নিরুদ্দেশ। দিশেহারা রেখা অবশেষে আশ্রয় নিয়েছেন কুড়িগ্রামের ফুলবাড়ী উপজেলার কবির মাহমুদ নামক গ্রামে ছোট বোন টুম্পা বেগমের বাড়িতে। ৮ বোন আর ৩ ভাইয়ের মধ্যে রেখা হলেন অষ্টম। তার দুই বোন ও এক ভাইও মারা গেছেন।

জানাগেছে, একটি শিশু ধর্ষণ মামলায় রেখা খাতুন ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর গ্রেফতার হয়ে লালমনিরহাট জেলা কারাগারে ছিলেন। ওই মামলায় তাকে ধর্ষণে সহযোগিতা করার অপরাধে আসামী করা হয়েছিল। মামলায় আরো দুইজন আসামী ছিলো। ২০০৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারী এই মামলায় রেখা খাতুনসহ অন্য আসামীদের যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদন্ড দেন আদালত। প্রত্যেকের এক লাখ টাকা করে জরিমানা করা হয়। অনাদায়ে তিন বছরের কারাদন্ডের আদেশ দেন আদালত। রেখা খাতুনের কারাভোগের মেয়াদ শেষ হয় গেল বছর ৩ ডিসেম্বর। কিন্তু তিনি জরিমানার টাকা পরিশোধ করতে না পারায় তিন বছরের জন্য আরে কারা ভোগ করছিলেন তিনি।

তবে রেখা খাতুনের দাবি, “শিশু ধর্ষণের ঘটনাটি সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। তার স্বামীর বড় ভাইয়ের কুপ্রস্তাবে রাজি না হওয়ায় তাকে এই মামলায় আসামী করা হয়। এই মামলার অপর দুই আসামীকেও সে চিনতো না। পরে জানতে পারে তার স্বামীর সাথে তাদের পরিচয় ছিলো। সে ২০০০ সালের ৫ নভেম্বর কারাগারে প্রবেশ করে আর কারাগার থেকে বের হয় ঈদের আগের দিন ২০২৪ সালের ৯ এপ্রিল। জরিমানার টাকা পরিশোধ করার ব্যবস্থা না হলে আরো ৩বছর কারাভোগ করতে হতো তাকে।

রেখা খাতুন বলেন, তার জন্য কেউ কোনদিন আদালতে জামিনের জন্য আবেদন করেননি। তার পক্ষে কোন আইনজীবি কোনদিন আদালতে কথা বলেননি। তিনি কারাগারে যাওয়ার তিন বছর পর তার স্বামী কোরবান আলী আর একজনকে বিয়ে করে নিরুদ্দেশ হয়েছেন। তিনি কোথায় আছেন তাও তিনি জানেন না। এখন সে কোথায় থাকবেন, কিভাবে বাঁচবেন! এমন দুশ্চিন্তাই করছেন সারাক্ষণ।
১৩-১৪ বছর বয়সে রেখা খাতুনের সাথে বিয়ে হয় ৩৪ বছর বয়সি কোরবান আলীর । দারিদ্রতার কারনে রেখা খাতুনে বাবা-মা এ বিয়েতে রাজি হয়েছিলেন। স্বামীর বয়ন বেশি হওয়ায় রেখা ২-৩ বছর স্বামীর বাড়িতে যায়নি। ১৯৯৮ সাল থেকে স্বামীর সাথে থাকতে শুরু করেন। রেখা ও তার স্বামী কোরবান আলী লালমনিরহাট শহরের খোচাবাড়ী এলাকায় একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন। তার স্বামী পেশায় একজন দিনমজুর ছিলেন।

রেখার ছোট বোন টুম্পা বেগম জানান, সামর্থ না থাকায় রেখা আপার জামিন করাতে পারিনি। বাবা-মা, ভাই-বোনসহ আপনজনদের মৃত্যুর খবরও তাকে দেওয়া হযনি। তার স্বামী ছিলো দুষ্ট প্রকৃতির। রেখা আপা জীবনে কোনদিনই সুখ পাননি।

কবি ও সমাজকর্মী ফেরদৌসী বেগম বিউটি জানান, “আমি রেখা খাতুণের জীবন-গল্প পুরোটাই শুনে তাকে কারাগার থেকে মুক্ত করার ব্যবস্থা করেছি। তাকে কিভাবে পুনর্বাসন করা যায় সেবিষয়ে পরিকল্পনা করছি।

লালমনিরহাট জেলা কারাগারের জেল সুপার ওমর ফারুক জানান, কারাগারে রেখা খাতুনকে হস্তশিল্পের ওপর প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। তিনি হস্তশিল্পের কাজ করে উপার্জন করতে পারবেন। রেখা লালমনরহাট কারাগারে ২৩ বছর ৪ মাস ৫দিন ছিলেন। জরিমানার টাকা পরিশোধ করায় ঈদের আগের দিন ৯ এপ্রিল রেখাকে কারাগার থেকে মুক্তি দেওয়া হয়।

লালমনিরহাট-৩ (লালমনিরহাট সদর) আসনের এমপি অ্যাডভোকেট মতিয়ার রহমান জানান, ‘তিনি রেখা খাতুনের বিষয়ে বিস্তারিত শুনেছি। তিনি জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলে তার পুনর্বাসনের জন্য ব্যবস্থা গ্রহন করবেন বলে জানান’।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *