কলমে -রাধা রানী বিশ্বাস

পূর্ণতার স্বামী অনুতাপ চৌধুরী শহরে বিজনেস ম্যাগনেট,একনামে সবাই তাকে চিনে । পূর্ণতা বড় হয়েছে গ্রামে। গ্রামে বড় হলেও সে শিক্ষিতা এবং
অসম্ভব সুন্দরী ।

অনুতাপ চৌধুরীকে বিয়ে দেওয়ার জন্য তার বিধবা মা হন্য হয়ে পাত্রী খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন ।
ছেলে অনুতাপ চৌধুরী জানিয়ে দিয়েছিল, “আমি সুন্দরী মেয়ে ছাড়া বিয়ে করব না। ”

তাই এক ঘটক এর মাধ্যমে শ্রীনাথ বাবুর কাছে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায়।
শ্রীনাথবাবু সাফ জানিয়ে দিয়েছেন, “এত অবস্থাপন্ন পরিবারে আমার মেয়েকে বিয়ে দিব না। তেল আর জল কখনোই একসাথে মিশে না। চৌধুরী পরিবারের সাথে আমাদের আকাশ পাতাল তফাৎ । ”

এলাকার গণ্যমান্য লোক ধরে শ্রীনাথ বাবুকে অনেক বুঝিয়ে রাজি করা হয়েছে ।
অনুতাপের মা শালিনী চৌধুরী বিয়ে ঠিক করে ছেলেকে বলেছিলেন, ” তোর মত অবাধ্য ছেলে
কারো ঘরে যাতে না হয়। তোর সিদ্ধান্তকে গুরুত্ব দিতে আজ ভিখারি ঘরের মেয়েকে ঘরে তুলতে বাধ্য হচ্ছি, নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে । ”

ছেলে তাকে পাত্তা না দিয়ে বলল,” আমি তো বলি নাই তুমি ভিখারির ঘর থেকে মেয়ে আন । ধর্নাঢ্য পরিবারে অনেক সুন্দরী মেয়ে আছে। তোমার বাবাও ভিখারি ছিল । ভাগ্য গুণে…..।” কথা শেষ করল না।

শালিনী দেবী চোখ বড় করে গজগজ করে বললেন, ” আর একটা কথা বলবি তাহলে তোর একদিন কি…। ”
কথা শেষ করার আগে ছেলে মোবাইল টিপতে টিপতে নিজের ঘরে চলে গেল।
শালীনি দেবী ছেলের কথাটা সহ্য করতে পারলেন না । রাগ দেখালেন ফুলকলির উপর। কাসার গ্লাসটা ঠাস করে নিচে রেখে বললেন, “গ্লাস ঠিক মত মেজে রাখবি। ” বলে অপেক্ষা করলেন না। চলে গেলেন ।

ফুলকলি নিশ্চুপ শালীনি দেবীর চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে রইল। আর মনে মনে বলল,” যত্তসব ঢং ! বিড়ালের রাগ বেড়ার উপর ঢালে। ”
বলে জোরে জোরে ঘষে কড়াইয়ের তেলকালি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।

একটা চাকুরীর ইন্টারভিউ দিতে এসেছিল পূর্ণতা
অনুতাপ চৌধুরীর অফিসে । সেই বায়োডাটা থেকে তথ্য নিয়ে মাকে দেয় অনুতাপ। এরপর ঘটকের মাধ্যমে বিয়ের প্রস্তাব পাঠায় শালীনি দেবী ।

শ্রীনাথ বাবুকে কোন টাকা খরচ করতে দেয়নি অনুতাপ চৌধুরী । সোনায় মুড়িয়ে অজপাড়া গাঁয়ে বেড়ে উঠা স্বর্গের অপ্সরাকে ঘরে তুলে ।

শ্রীনাথবাবু বারবার ঘটককে বলেছেন, “পূর্ণতা গাঁয়ে বড় হয়েছে । শহুরে চালচলন নিয়মনীতির সাথে পরিচিত নয়। এজন্য পদে পদে আমর মেয়েকে এই বড়লোক শশুড় বাড়িতে চরম মূল্য দিতে হতে পারে । তুমি ফিরে যাও। ”

বিয়ের দিন রাতেই শ্রীনাথবাবু বুঝেছিলেন মেয়ের ভবিষ্যৎ । মেয়ের জন্য গহনা গড়তে দিয়েছিলেন । ঠিক সময় ডেলিভারি দিতে না পারায় পুরাতন কম ওজন, স্ত্রীর গহনা পড়িয়ে বিয়ের পিড়িতে বসান।
পূর্ণতার শাশুড়ী উঠোন ভর্তি মানুষের সামনে গহনা দেখে বলেন, “আপনারা মেয়েকে বাড়ি থেকে বিদায় দিচ্ছেন এই ভাবে ! ”
একটানে খুলে ছুড়ে ফেললেন পূর্ণতার গলার হারটা । পড়ল গিয়ে শ্রীনাথ বাবুর পায়ের কাছে । এরপর ছেলের বউকে হীরের গহনা পড়িয়ে দেন।

মাথা নিচু করে অঝোরে নিঃশব্দে কাঁদছে পূর্ণতা।
চোখের জলে কাজল গলে বিয়ের সাজ, মুহূর্তে
কাদাজলের স্রোতের মত গড়িয়ে যাচ্ছে । প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে, যাতে কান্নার শব্দ না হয়। ও কান্না করলে বাবা সহ্য করতে পারবে না। মনে মনে বলছে, ” ঈশ্বর তুমি আমাকে ধৈর্য্য দাও। আমার বাবার সম্মানটুকু বাঁচাও প্রভু। ”

শ্রীনাথবাবুর বাল্য বন্ধু হাবিব পাশে দাঁড়িয়ে ছিল।
দাঁতে দাঁত চেপে বলল, “শ্রীনাথ তুই শুধু বল। এই অপমানের বিচার এখনই করি। ”

“বন্ধু আমি জানি আমার মেয়েকে তুই তোর নিজের মেয়ে মনে করিস। তাই একথা বলছিস। তবুও আমি তোকে নিষেধ করি । এখন কিছু বললে আমার মেয়েকে লগ্নভ্রষ্টা করে ফেলে চলে যাবে ওরা ।”
একথা বলে কান্না করে দিলেন শ্রীনাথবাবু ।

আত্নীয়স্বজন দুচার কথা বলে থেমে গেছে, মেয়ের সুখের কথা চিন্তা করে ।

পূর্ণতার আজ কত গহনা আছে তা সে খোঁজ রাখে না। গা ভর্তি গহনা। সব শশুড় বাড়ির পক্ষের আত্নীয় পরিচিত আর স্বামীর দেওয়া। স্বামীর মুখ থেকে শুনেছে সে, বাকিগুলো নাকি ব্যাংকের লকার ভাড়া করে রাখা আছে । তার এসবের মধ্যে কোন আগ্রহ নাই । মায়ের গহনা ছুড়ে ফেলে দেওয়ার দৃশ্য আজও মনে পড়লে চোখের কোনা দুটো জলে ভরে উঠে ।

বিদায়ের সময় মা বাবা হাত ধরে বলেছিলেন, ” মা তোকে কোথায় পাঠাচ্ছি জানিনা। তবে ঈশ্বর তোকে সব সময় যেন ভাল রাখেন। ” হাবিব চাচা অদূরে দাঁড়িয়ে চোখ মুছছে পাঞ্জাবির হাতার কাপড় দিয়ে । সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় পূর্ণতা, “চাচা! বাবাকে…..!” আর কিছু বলতে পারে নাই পূর্ণতা।
হাবিব চাচা শুধু হাত উঁচু করে বললেন, ” যা মা চিন্তা করিস না। ”

বিয়ের পর একদিন স্নান সেরে, নিজের কাপড় কেঁচে ছাদে শুকাতে দিতে গিয়েছিল পূর্ণতা।
শাশুড়ী বললেন, ” এই বাড়ির বউ কখনো ছাদে উঠে না। এগুলো ফুলকলির কাজ। ”

পূর্ণতা বাড়িতে সকালে গরম ভাতে ঘি খেত। মায়ের হাতে তোলা ঘি দিয়ে আলুসিদ্ধ ভাত তার খুব পছন্দ ।
এই বাসায় কেউ সকালে ভাত খায় না। সবাই ঘুম থেকে উঠে চোখ কচলাতে কচলাতে ডাকে,” এই….চা কোথায়…! ফুলকলি..!”

বিছানায় বসে চা পান করে। পূর্ণতার এটা দেখলে বমি আসে। সবাই টেবিলে বসে পাউরুটি বাটার আর জেলি দিয়ে মাখিয়ে খায়, ফলের জুস খায়। এরপর আয়েশ করে আবার চা খায়।

পূর্ণতা ফুলকলিকে বলে,” আমি একটু ভাত রান্না করে খাব। তুমি তাদের বলো না প্লিজ । ”
ফুলকলিও গ্রামের মেয়ে। তারও প্রথম প্রথম খুব কষ্ট হত। তাই সে বলল, ” বৌদি আমি বলব না তুমি রান্না কর। আমিই তোমাকে রান্না করে
দিতাম । কিন্তু গিন্নি মা আর ছোট বৌদি দেখলে আমাকে অনেক বকবে। ”

পূর্ণতা লুকিয়ে প্রতিদিন রান্না করে খেত। একদিন শাশুড়ীর চোখে পড়লে ঝংকার দিয়ে বলে উঠেন, ” এই ভিখারির বাচ্চাকে কোথা থেকে তুলে এনেছে। বাসার কাজের বুয়ার মত ভাত খায় সকালে। ”

কথাটা শুনে খুব কেঁদেছিল পূর্ণতা। তাদের অনেক টাকা না থাকলেও, তার বাবাকে কখনো টাকা ধার করতে দেখেনি। বরং নিজের সংসার চালিয়ে
মানুষকে সাহায্য করেছেন।
গোলা ভরা ধান, কয়েকশ মণ পাট তুলত
মৌসুমে । পুকুরে মাছ, আম কাঁঠাল পেয়ারার বাগান কি নেই তাদের !

অনেকক্ষণ এলোমেলো কষ্টের স্মৃতিগুলো, মনের
ভাঁজে ভাঁজে সংরক্ষিত অবস্থা থেকে টেনে টেনে বের করে দেখছিল পূর্ণতা।
ছোট বউ আর শাশুড়ী টিভি দেখছেন । পূর্ণতা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে তাড়াতাড়ি নিজের কাপড় আয়রন করতে গেল।

ফুলকলি নিচ থেকে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে
” ও..বড় বৌদি! বড় বৌদি….. বৌদি…। ”
ডাকতে ডাকতে রান্না ঘরে ঢুকে গেল । কোন সাড়া না পেয়ে আবার ডাকতে শুরু করল, ” ও….বড় বৌদি…..। ”

পূর্ণতা নিরবে কাপড় আয়রন করছে। কোন জবাব দিল না। সব কথা শুনতে পাচ্ছে।
পূর্ণতার শাশুড়ী সবার কাপড় দোকানে পাঠান।
কিন্তু পূর্ণতা তার কাপড় দিতে চাইলে বলেন, ” আজ কাপড় বেশি,পরে দিও। বাপের বাড়ি কি কাপড় আয়রন করে পড়েছ? ”

যতদিন কাপড় দিতে চেয়েছে, একই কথা বলেছেন শালীনি দেবী। তাই সে কাপড় নিজে
আয়রন করে নেয়।

ফুলকলি ডাকতে ডাকতে পূর্ণতার ঘরে এল, “ও..বৌদি… বৌদি…! ”

পূর্ণতা একটু ফিরে তাকিয়ে বলল “কিরে ফুলকলি! জল খেয়ে নে। তোর তো গলা শুকিয়ে গেল ডাকতে ডাকতে । যা আসছি। তোর মাছ কেটে দিব। ”

“ও….বৌদি রাগ করো না, তোমাকে ছাড়া কাকে বলব? এই বাড়িতে আমার কথা বলার কে আছে বল! ”

পূর্ণতা হাত উল্টে কুনই দেখছে আর বলছে, ” তোর কথা শুনে মনে হচ্ছে বাড়ির সবাই বোবা। শুধু আমি কথা বলতে পারি । এখন যা ফ্রিজ থেকে বরফ নিয়ে আয়। হাতে গরম ইস্ত্রির ছ্যাকা লেগেছে । ”

এবার ফুলকলি বুঝতে পেরে দৌঁড়ে বরফ আনতে গেল।

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *