লেখক -লায়লা আঞ্জুমান

কর্তা আজ অফিস থেকে ফেরার পথে দুই কেজি শিং মাছ নিয়ে এসেছে। বাড়ি থেকে অফিসের দূরত্ব ৩২ কিলো তাই ৯টা-৫টা অফিস করে ফিরতে কিছুটা রাত হয়। তাই কর্তা ফেরার আগেই আমি নিত্যকর্ম সম্পাদন করে ছেলে -মেয়েকে পড়তে বসাই। এখন নতুন বইপত্র হাতে না আসায় বাচ্চাদের কিছুটা অবসর, অবসর আমার ও। এই সময়টা এখন একান্তই আমার। সুতরাং তড়িঘড়ি সবকাজ শেষ করে বিছানায় উঠে পড়ি। পায়ের ওপর কম্বলটা টেনে নিয়ে কাঁথা সেলাইয়ে বসে পড়ি। কর্তা বাসায় ফেরার পর কাঁথা সেলাই দেখলে ভীষণ ক্ষেপে যান। এ নিঃষ্প্রান জড় বস্তুটি যেন তার সাত জন্মের শত্রু।

এরকম একান্তই নিজের জন্য অতি যত্নে বাঁচিয়ে রাখা সময়টিতে কর্তাকে মাছ হাতে ঢুকতে দেখে মেজাজ তো ভীষণ তিরিক্ষি। অনেকটা গৃহযুদ্ধ লাগার উপক্রম। কিন্তু কর্তা বেচারা অতি সাবধানে তা সামলে নিলেন। আমি রেগেমেগে বললাম, এমাছ আমি কাটব না। মাছ তুমি কাটবে, ধুবে এমনকি রান্না ও করবে।

“ঠিক আছে তুমি বিরক্ত হয়োনা। এদিকে এসে দেখইনা কী চমৎকার শিং মাছ। এগুলো ১০দিন জিইয়ে রাখলে ও সমস্যা নেই। আস্তে আস্তে কেটে খাওয়া যাবে।”

“অতশত বুঝিনা মাছ কিন্তু আমি কাটব না বলে দিলাম। সকালে স্কুলে বেরোবার তাড়া থাকে মাছ কাটার সময় আমার নেই।”

কর্তা মেনে নিয়ে সম্মতি জানালে সহজেই সংসারে শান্তির সুবাতাস বইল। রহিমা খালা চলে যাওয়ার পর আমার কাজ যে কত গুণে বেড়েছে তা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দেশের অন্যান্য এলাকার লোকেরা যাদের বুয়া ডাকে আমরা রাজশাহী এলাকার মানুষরা তাদের ভালোবেসে খালা ডাকি। দেশের বিভিন্ন এলাকায় এধরণের মানুষদের ওপর জুলুম-নির্যাতনের যে গল্প প্রায়ই মিডিয়ায় আসে। আমাদের এলাকায় খালাদের চালচিত্র অনেকটাই ভিন্ন।

একদিন স্কুল থেকে ফিরে দেখি ছেলেটি আমার মনমরা হয়ে বসে আছে। শুধালাম, কী হয়েছে বাবা মন খারাপ কেন?

আমি কাল থেকে আর স্কুলে যাবনা।

কেন? ম্যাম বকেছে?

মাথা নাড়িয়ে না জানালো।

তাহলে বন্ধুদের সাথে ঝগড়া নিশ্চয়ই?

বিরক্ত মুখে বলল, না। ম্যাম ক্লাসে যাদের দাদা আছে তাদের দাঁড়াতে বলেছিল। আমি দাঁড়াতে পারি নি। তারপর বলল যাদের বাড়িতে দাদী আছে তাদের দাঁড়াতে। সবাই দাঁড়িয়ে গেল শুধু আমি দাঁড়াতে পারলাম না। আমার ও তো আপি আছে (নানিকে ও আপি বলে)। আপির কথা বললে আমি ও তো দাঁড়াতে পারতাম বলেই ফুপিয়ে কেঁদে উঠলো।

সেদিনই বুঝেছিলাম দাদা-দাদির জন্য আমার সন্তানদের মাঝে কতটা শূন্যতা। ছেলের কান্নায় আমার চোখের কোনায় ও সেদিন কিছুটা জল জমে ছিল কিনা আজ আর ঠিক তা মনে নেই তবে লিখতে গিয়ে চোখের কোনটা কেমন যেনো ভিজে উঠল। ছেলেকে সেদিন অনেক কঠিন বাস্তবতা শিখিয়েছিলাম কতটুকু তার বোধগম্য হয়েছিল জানি না। সেদিন থেকেই রহিমা খালাকে দাদি ডাকতে শিখিয়েছিলাম। আমার ছেলে -মেয়েরা তাকে দাদি বলেই ডাকতো। খালা ও পরম মমতায় তাদের জড়িয়ে রাখতো। আমার কর্মব্যস্ততার কারণে খালাই তার নাতিকে স্কুলে নিয়ে যেত। মাঝে মাঝে ছেলের খোঁজ নিতে স্কুলে গেলে অনেকই শুধাতো, এটা কী আপনার শাশুড়ী?

কখনো কখনো শুনতাম আমার ছেলে স্কুল থেকে হেঁটে বাসায় ফিরেছে। বেচে যাওয়া গাড়ী ভাড়া দিয়ে সে দাদিকে পান কিনে দিয়েছে। আবার খালার আর তার মধ্যে চকোলেট ভাগাভাগির দৃশ্য দেখলে ও বুঝতাম শিশু-বৃদ্ধের মাঝে কী চমৎকার আত্মিক বন্ধন তৈরি হয়েছে।

সকালে তড়িঘড়ি সাংসারিক কাজ শেষ করে কোনরকমে দু-একটি রুটি গলাধঃকরণ করে, হিজাব লাগিয়ে, কাঁধে ব্যাগটা ঝুলিয়ে ছুটতাম স্কুলের পথে। সেখানে আমার জন্য অপেক্ষা করত বৃহৎ আরেকটি পরিবার, শত শত ছেলে -মেয়ে। সেখানে দায়িত্ব পালনে ভুলে যেতাম সকালে রেখে যাওয়া আমার শান্তিময় ছোট্ট পরিবারটিকে। ক্লান্ত দেহে বিকেলে ফিরে দেখতাম সব আগলে রেখেছে আমার রহিমা খালা। এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছিলেন আমার পরিবারের নির্ভরতার জায়গা। সেদিন না বুঝলেও আজ তা ভীষণ ভাবেই উপলব্ধি করি।

রহিমা খালার হাতে যত্নেই ছিল আমার পরিবারটি। হঠাৎই বিশ্বজুড়ে তার ভয়াল থাবা বসালো ভয়াল করোনা। থমকে গেল পৃথিবী। ভেঙে গেল প্রতিটি পরিবারের স্বাভাবিক জীবন যাপন। খালাকে বললাল, আপাতত বাসায় বসে বিশ্রাম নেন। কাজে আসার দরকার নেই।

চোখ দুটো ছলছল করে খালা বলল,প্যাটতো আছে, খাবো কী?

খালার বাড়ি আমার বাসা থেকে বেশ খানিকটা দুরে আবার তিনি রাতে নিজ বাড়ি ছাড়া অন্য কোথাও থাকতে ও চাননা। তাই বললাম সেই চিন্তা আপনাকে করতে হবে না। প্রতি মাসে এসে টাকা নিয়ে যাবেন আর বাড়ি থেকে একদম বের হবেন না। আপনার তো বয়স হয়েছে।

খালা খুশিমনে বাড়ি গেলেন। নিয়ম করে টাকা নিয়ে যেতেন। রমজানে প্রয়োজনীয় বাজার করে খালাকে পাঠালাম। ডেকে পাঠালাম ঈদের আগের দিন। নতুন শাড়িসহ প্রয়োজনীয় বাজার করে দিলাম। ঈদের পরেরদিন আনুমানিক রাত ১১টা। টিভি দেখছিলাম। হঠাৎ ফোনটা বেজে উঠল। ওপাশ থেকে ধরা গলায় খালার ছেলে, আপা মা কিছুক্ষণ আগে মরি গেল।
বুকটা ভারি হয়ে উঠলো আর হাত -পাগুলো অবশ হয়ে গেল যেন। সারারাত ঘুমাতে পারলাম না। ভোরবেলায় ছুটে গেলাম খালাকে দেখতে। দেখলাম খালার নিথর দেহখানা আমার দেয়া নতুন শাড়ীখানা জড়িয়ে উঠোনে পড়ে আছে।

দুই দিন জিইয়ে রাখার পর শুক্রবার ছুটির দিন কর্তা মাছ নিয়ে ছুটলেন ছাদে। কাটবোনা বললেও ছুটলাম তার পেছন পেছন। দুজনে মিলে মাছ কাটা শেষ হলেও পরিষ্কার নিয়ে হিমশিম অবস্থা। শত ঘষাঘষিতেও পরিষ্কার হয়না। হঠাৎ মনে পড়লো শিং মাছ আনলেই খালা পেঁপে পাতা খুঁজে আনতেন। পেঁপে পাতা আনা হলো। ঘষা দিতেই শিং তার কৃষ্ণবর্ন হারিয়ে ধবধবে হলো। আকাশের দিকে তাকিয়ে রহিমা খালাকে বললাম, একদিক থেকে তোমরা ও আমাদের শিক্ষক। প্রাত্যাহিক জীবনের কতকিছুই না তোমাদের কাছে শিখি কিন্তু মূল্যায়ন করিনা মোটেই যেন সামান্য বেতনেই কিনে নিই তোমাদের। ভালো থেকো শিক্ষাগুরু ওপারের জীবনে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *