প্রকৌশলী সরদার সায়িদ আহমেদ

সম্প্রতি যে স্থানে উল্কাপাত ঘটেছে তার নাম গোল্ডেন শহর। ছোট্ট এই শহরটি কানাডার দক্ষিণপূর্ব ব্রিটিশ কলাম্বিয়ায় অবস্থিত । ভ্যানকুভার হতে প্রায় ৭৪১ কিমি পূর্ব দিকে এবং ক্যালগোরি হতে ২৬২ কিমি পশ্চিমে এর অবস্থান । এ শহরে লোক সংখ্যা একেবারেই কম, মাত্র তিন হাজার সাত শত লোকের বসবাস । এই তো ক’দিন আগের কথা, সেদিন ছিলো ৩ অক্টোবর ২০২১ ইং ।

সন্ধ্যা থেকেই সেখানকার আকাশে মেঘের জটলা , থেকে থেকে হালকা বৃষ্টির সাথে বিদ্যুৎ চমকানি। রিমঝিম বৃষ্টির মৃদু শব্দে ঘুমের আবেশ আসাটাই স্বাভাবিক । এখানে মাসিক গড় তাপমাত্রা অকোবরে, উপরে ১০.১ ও এই নিম্নে মাইনাস ০.২ ডিগ্রী সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। এই শহরেরই এক বাসিন্দা মিস্ রুথ হ্যামিলটন, বয়স ৬৬ বৎসর। বাড়িতে তিনি আর তার পোষা কুকুর ছাড়া ঘটনার রাতে কেউ ছিলেন না । মিস্ হ্যামিলটন ক্লান্তির কারনে ঘটনার দিন কিছুটা আগেই ঘুমিয়ে পড়েছিলেন ।

স্থানীয় সময় রাত ১১:৩৫ মিনিটে কিছু একটা বিকট বিস্ফোরনের শব্দে তার গৃহপালিত কুকুরের আতংকিত ঘেউ ঘেউ ডাকে হ্যামিলটনের ঘুম ভেঙ্গে যায় এবং তিনি তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে উঠে বাতি জ্বালিয়ে দেখার চেষ্টা করেন কোথায় কি হয়েছে। প্রথমে তিনি ভেবেছিলেন তার ঘরের উপর হয়তো কোন গাছ ভেঙ্গে পড়েছে। কিন্তু না আশপাশের পরিচিত সব গাছ নিজ নিজ অবস্থানেই রয়েছে । এরপর ভাল করে আরো একবার কারন অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখতে পেলেন তার শোবার ঘরের ছাদ বিছানা বরাবর উপরে ছিদ্র হয়ে আছে আর সেই বরাবর তারই বিছানার বালিশের পাশে ধুসর রং এর একটি বস্তু পড়ে আছে ।

অবাক কান্ড, এটি কি বা কোথায় থেকে এলো ভেবে পাচ্ছিলেন না মিস্ হ্যামিলটন। এলোমেলো চিন্তা ভাবনার মাঝে মনে হলো বিষটি সম্পর্কে জানা জরুরি।

তাই বিলম্ব না করে মিস্ হ্যামিলটন জরুরি কল সেন্টারের ৯১১ নম্বরে কল দিয়ে বিষযটি জানালেন। তার কল পেয়ে এক অফিসার মিস্ হ্যামিলটনের বাড়িতে এসে অপরিচিত বস্তুটি দেখে দুটি মন্তব্য করলেন। তিনি বললেন আশপাশে রাস্তার কাজের পাথর সংগ্রহের জন্য খনিতে বিস্ফোরনের কারনে হয়তো বস্তুটি ছিটকে এখানে এসে পড়েছে। মিস হ্যামিলটন জানালেন তিনি খোজ নিয়ে জেনেছেন ঘটনার রাতে রাস্তার কাজের জন্য খনিতে কোন বিস্ফোরন ঘটানো হয়নি সুতরাং এটি অন্য কিছু হবে ।

এরপর অফিসার বললেন তা হলে এটি উল্কাপিন্ড (Meteorites) হতে পারে। অফিসার চলে যাবার পর বাকি রাতটা মিস্ হ্যামিলটন দু’চোখের পাতা আর এক করতে পারলেন না। তিনি ভাবতেই পারছেন না তার কি হতো যদি অচেনা বস্তুটি তার বালিশের পাশে না পড়ে মাথায় পড়তো । যা হোক চেয়ারে বসেই নানা দু:শ্চিন্তায় রাত কাটিয়ে দিলেন। পরের দিন আস্তে আস্তে বিষয়টি অনেকে জেনে গেলেন। খবর পেয়ে ক্যালগোরি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন বিশেজ্ঞ মিস্ হ্যামিলটনের বাড়িতে এসে বস্তুটিকে আকাশ হতে পতিত উল্কাপিন্ড বলে নিশ্চিত করলেন।

সেই সাথে গবেষকদল এটি পেয়ে অত্যন্ত খুশী হলেন এই কারনে যে বিভিন্ন সময়ে পৃথিবীর নানা স্থানে উল্কাপাতের কথা জানা গেলেও গবেষনার জন্য হাতের নাগালে বস্তগুলি খুব একটা পাওয়া যায় না ।

বিজ্ঞানীরা বলছেন প্রতি ঘন্টায়, প্রতিদিন উল্কা (Meteor বা Fireball) মহাকাশ হতে ভূ-পৃষ্ঠের দিকে অনবরত ধাবিত হয়, তবে এর সিংহভাগ পৃথিবীর বায়ূমন্ডলে প্রবেশের পর আকাশেই জ্বলে ধ্বংস হয়ে যায় । আর আকৃতিতে যে গুলি বড় এবং গতিপথে টিকে থাকে, আংশিক ভেঙ্গে গেলেও, সে গুলিই কেবল ভূ-পৃষ্ঠে পৌঁছতে পারে। এই ভাবে ভূ-পৃষ্ঠে নেমে আসা বস্তুকেই বিজ্ঞানীরা বলছেন উল্কাপাত (Fall of Meteor) আর যে বস্তুগুলি পৃথিবীতে পৌঁছে যায় তাকে বলা হয় উল্কাপিন্ড (Meteorites). পৃথিবীর বায়ূ মন্ডলে যখন ঊল্কা দ্রুত বেগে ছুটে আসে তখন এগুলিতে আগুন ধরে যায় এবং দৃষ্টি সীমার মধ্যে থাকলে তা আমরা দেখতে পাই। ছোট বেলায় দেখেছি আকাশে দৃশ্যমান উল্কার পতন দেখলে বড়রা বলতেন এগুলি জিন-ভূতের চলাচলের দৃশ্য আবার কেউ কেউ বলতেন শয়তানকে তাড়ানোর জন্য স্রোষ্টা অগ্নিবল বা উল্কাপিন্ড নিক্ষেপ করে থাকেন ।

রাতের পরিষ্কার আকাশের দিকে তাকালে এখনো বিভিন্ন সময়ে উল্কা দৃশ্যমান হয় যাকে আমরা তারকা (star) বা গ্রহানু (asteroid) বলে ভুল করে থাকি। বিজ্ঞানীদের মতে বাস্তবে ওগুলি উল্কা, মহাকাশের উচ্ছিষ্ট বস্তু, এগুলিকে তারার মত দেখালেও এরা তারা (Star) নয়। আমরা যেগুলো দেখি সেগুলি মাইক্রোমেটিওরয়েড (micrometeoroid). এরা মূলত সিলিকন, অক্সিজেন, নিকেল ও আয়রন এই উপাদানগুলি দিয়ে গঠিত। গবেষনায় প্রমান পাওয়া গেছে উল্কাপিন্ড যখন বায়ূমন্ডলের ভিতর দিয়ে শব্দের চেয়ে ৫০ গুনের অধিক গতিতে চলে তখন এগুলির তাপমাত্রা দুই হাজার ডিগ্রী সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত পৌঁছায়। এদের উৎপত্তি বিন্দু হতে পৃথিবীতে যে সব উল্কাপিন্ড নিপতিত হয় সেগুলির ওজনে/আকারে প্রায় শতকরা ৯০ ভাগ ছোট হয়ে আসে। কানাডার গোল্ডেন টাউনে সম্প্রতি মিস্ রুথ হ্যামিলটনের গৃহে যে উল্কাপিন্ডটি পড়েছে তার ওজন ২.৮ পাউন্ড বা ১.২৬ কেজি। এর অর্থ উৎসে এটি গতিপথে আসার আগে এর ওজন ছিলো প্রায় ২.৩৯৪ কিলোগ্রাম।

১৪ই অক্টোবর ২০২১ ইং এর সংখ্যায় ”দ্যা নিউ ইয়োর্ক টাইমস্ “ উপরের তথ্যগুলি ছাড়াও যে বিষয়টি তুলে ধরেছে তা হলো উল্কাপাতের ঘটনা অহরহ ঘটলেও মানুষের বসতগৃহে আঘাত হানার উদাহরন খুব বেশী নেই। গোল্ডেন শহরে উপরে উল্লেখিত উল্কাপাতের মাত্র দু’বছর আগে ৪.৪ পাউন্ড বা ১.৯৯ কিলোগ্রাম ওজনের উল্কাপিন্ড ইন্দোনেশিয়ার এক কফিন মেকারের গৃহে আঘাত করলে তিনি বেহুশ হয়ে পড়ে যান। আবার ১৯৮২ সনে ৬ পাউন্ড বা ২.৭২ কিলোগ্রাম ওজনের উল্কাপিন্ড দ্বিতল বাড়ির উভয় ছাদ ফুটো করে পতিত হয়েছিলো যুক্তরাষ্ট্রের কানেকটিকাটের ওয়েদার্সফিল্ড শহরে। ক্যালগোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর ব্রাউন বলেন মানুষের গৃহে এবং শয়ন কক্ষের বিছানায় এমন উল্কাপিন্ডের পতন কোন একটি বছরে ১ বিলিয়নের মধ্যে মাত্র ১ টি। অর্থাৎ সারা বছরে যদি ১০০ কোটি উল্কাপাত ঘটে তাহলে এর মধ্যে মাত্র ১ টি মানুষের গৃহের বিছানায় পড়ার সম্ভাবনা থাকে।

উল্কাপিন্ডের আকৃতি, ওজন ও বস্তুর গুনাগুণ ভেদে এর মূল্য অনেক। জানা যায় ভূ-পৃষ্ঠে প্রাপ্ত খাটি স্বর্ণের মূল্যের চাইতে এগুলির মূল্য প্রায় চল্লিশগুন বেশী। সিএনএন এর ৩০শে এপ্রিল ২০২০ সনের একটি পোষ্ট থেকে জানা যায় ২০১৮ সনে সাহারা মরুভূমি হতে একটি ৩০ পাউন্ড বা ১৩.৬১ কিলোগ্রাম ওজনের লুনার উল্কাপিন্ড পাওয়া যায়, যার পরিচিতি নং NWA 12691. এই উল্কাপিন্ডটির মূল্য ২.৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বা বাংলাশেী মুদ্রায় ২১,৩৯,২৫,৪৫০ টাকা নির্ধারন করা হয়েছে।

উল্কা দিয়ে তৈরী তরবারি একসময় রাজ রাজড়াদের হাতে এবং দরবারে শোভা পেত। এসব অনেক তরবারি তৈরী করা হতো গ্রহানু বা উল্কাপিন্ড থেকে পাওয়া লোহায়। উল্কাখণ্ডকে বিভিন্ন ধাতুর সঙ্গে মিশিয়ে এরপর অ্যাসিডে খোদাই করে এক ধরনের নকশা তৈরি করা হতো। উল্কাপিণ্ডের লোহায় থাকা নিকেলের কারণে তা বেশি রুপালি দেখায়।

উল্কাখণ্ড থেকে তৈরি এসব তরবারির মধ্যে রয়েছে অ্যাটাক্সি তরবারি, সম্রাট জাহাঙ্গীরের তরবারি, জেমস সোয়ার্বির তরবারি, ক্রিস ও টেরি প্র্যাটচেটের তরবারি ইত্যাদি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *