সরেজমিন প্রতিবেদন

দীঘলকান্দি আশ্রায় প্রকল্প ঘুরে এসে নাজমুল হুদা পারভেজ ঃ
ব্রহ্মপুত্র নদের করাল গ্রাসে যখন প্রচন্ড নদী ভাঙন, যখন মানুষের ঘর-বাড়ি নদীতে ভাসছে । যখন অসহায় মানুষরা তাদের পরিবার পরিজন নিয়ে কোথায় যাবে? কোথায় আশ্রয় নিবে?- তা ভেবে দিশেহারা। এ রকম পরিস্থিতিতে স্থানীয় প্রশাসনসহ জন প্রতিনিধিদের যখন সাধারণ নদী ভাঙ্গা পরিবার ও বানভাসি মানুষের পাশে এসে দাঁড়াবার কথা, ঠিক সেই মুহ‚র্তে তাদের বিরুদ্ধেই সাধারণ মানুষ অভিযোগ তুলেছে প্রধানমন্ত্রীর আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় নির্মিত আশ্রায়ন কেন্দ্রে আশ্রয় নিতে কোন কোন জনপ্রতিনিধি আশ্রায়ন প্রকল্পের ঘরে ।আশ্রয় পেতে হলে ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউএনওকে টাকা দিতে হবে বলে বানভাসি ও নদীভাঙ্গা পরিবার গুলোন নিকট থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা নিয়ে তবেই আশ্রায়ন কেন্দ্রের নির্মিত ঘরে আশ্রয় দিচ্ছে।
ঘটনাটি ঘটেছে কুড়িগ্রামের চিলমারী উপজেলার অষ্টমীরচর ইউনিয়নের খোদ্দবাঁশপাতার এলাকায় সদ্য নির্মিত দীঘলকান্দি আশ্রায়ন প্রকল্পে।এ ধরনের অভিযোগের ভিত্তিতে মঙ্গলবার দুপুরে নৌকা ভাড়া করে উত্তাল ব্রহ্মপুত্র নদ পারিয়ে ্উক্ত আশ্রায়ন কেন্দ্রে সরেজমিনে গিয়ে আশ্রয় নেয়া নতুন পরিবারগুলির সাথে কথা বলে ঘটনার সত্যতা মিলেছে।
অষ্টমীরচর এলাকার খোদ্দ বাঁশপাতার গ্রামটিতে আজ প্রায় ১০/১২ দিন পূর্ব থেকে নদী ভাঙন তীব্র আকার ধারণ করে। মাত্র কিছুদিন পূর্বে গ্রামটির সামান্য অদূরে সরকারের পক্ষ থেকে দীঘলকান্দি আশ্রায়ন প্রকল্পের আওতায় মাটি উঁচু করে ১০০টি পাকা টিন শেড ঘর নির্মাণ করা হলেও চলমান বন্যার পূর্বে সেখানে আনুষ্ঠানিক ভাবে হতদরিদ্র ও গৃহহীনদেরকে প্রশাসন ও ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষ থেকে নির্বাচিত করে উক্ত ঘর গুলি কোন পরিবারের নামে বরাদ্দ দেয়া হয়নি। সম্প্রতি খোদ্দ বাঁশপাতার গ্রামটিতে তীব্র নদী ভাঙন দেখা দিলে ভাঙন কবলিত পরিবার গুলি তাদের বাড়ি ঘর ভেঙ্গে নিয়ে আশ্রায়ন কেন্দ্রটিতে উঠতে বা আশ্রয় নিতে শুরু করে। ঠিক সেই মর্হ‚তে দু’জন ইউপি সদস্য ও,একজন সংরক্ষিত মহিলা সদস্যের লোকজন প্রশাসনকে টাকা না দিলে ঘরে ওঠা যাবে না বা ঘর বরাদ্দ দেয়া হবে না -এ ধরনের কথা বলে আশ্রায়ন কেন্দ্রে আশ্রিতদের নিকট থেকে ৫ থেকে ১০ হাজার টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলেছে আশ্রিতরা।
সেখানে আশ্রয় নেয়া খোদ্দ বাঁশপাতার গ্রামের নদীভাঙ্গা মৃত কবেদ আলীর স্ত্রী মোছাঃ জেলেমন বেওয়া (৬৫) এ প্রতিনিধিকে বলেন, আমি ৫/৬ দিন পূর্বে এই আশ্রায়ন কেন্দ্রে ঘর ভেঙে আসি , এইবার নতুন যে মেম্বর হইছে সেলিম তার শ্বশুর মুরালের হাতে আমি ৫ হাজার টাকা দিছি। আমি তাক বলছি, আমার কর্মচারী নাই, বেডা-পুত্র নাই, ভাত-কাপর নাই, অন্যের বাড়ি কাম কইরা খাই। ট্যাকা ছাড়া ঘর দেয় না। ট্যাকা দিতে দেরি করায় অমার উপর চাপ সৃষ্টি করে। বধ্য হয়্যা আমি এই ট্যাকা জোগার করনের লাইগা চরে মাইনষের ভুট্টা তুলছি বাবা। ভুট্টা তুইল্যা বাবা, কামলা দিয়া, কৃষান কয় না? তাই কইরা আমি বহু কষ্টে ট্যাহা জোগার কইরা, হের পরে ট্যাহা দিয়া এই ঘরে উঠছি।
খোদ্দ বাঁশপাতার গ্রামের বাজাজ শেখের স্ত্রী আছিয়া খাতুন (৭০) জানান, বাড়ি ভাঙছে আইজ পাঁচ দিন হইল। রানিং মেম্বর সেলিমের বোন জামাই মুকুলের কাছে ৫ হাঁজার ট্যাকা দিছি ঘরে উঠার জন্যে। তাছাড়া উঠতে দেয় না।
খোদ্দ বাঁশপাতার গ্রামের মোঃ রহমত আলী (৪৮) জানান, বাড়ি ভাঙছি ৫ দিন হইল আর ঘরে উঠছি কাইলক্যা। ট্যাকা আগেই তো দিছি ৯নং ওয়ার্ডের মেম্বার সেলিমের বোন জামাই মুকুলের হাতে।
একই গ্রামের নদী ভাঙা সোরাব আলীর স্ত্রী মোছাঃ সুফিয়া খাতুন (৪৫) জানান, গত শুক্রবারের দিন বাড়ি ভাঙ্গছি। হাওলাত-বরাত কইরা ট্যাকা দিছি। মিছা কতা কবার পামুনা। বেটা ছাওয়া (স্বামী) কাক দিছে সেটা জানি না। স্বামী তো কামে গেছে , অহন নাই। আমি ৮ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা।
একই গ্রামের নদী ভাঙা মৃত মনছের আলীর পুত্র মোঃ আব্দুল বারেক কে, কাউকে টাকা দিয়েছেন কিন ?-জানতে চাইলে প্রথমে উত্তর দেয়, না। কাইরে কোন ট্যাকা দেই নাই। বাধ্য হয়ে সত্যটা বেড় করতে এ প্রতিনিধি বারেককে বলে , টাকা না দিলে তো আপনাকে সরকারি ঘরে থাকা যাবে না। এখানে থাকতে হলে টাকা দিতে হবে । তাছাড়া চেয়ারম্যান, মেম্বার ও প্রশাসন তো আপনাকে বেড় করে দিয়ে অন্য জনকে এ ঘরে ঢুকিয়ে দেবে। এই কথা শোনা মাত্রই আব্দুল বারেকের মুখ থেকে সত্য কথাটা বেড় হয়ে আসে, তিনি বলেন, তিন দিন হইল আইছি। কিছু ট্যাকাও দিছি। কাকে দিয়েছেন? ৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার এর ভাই জুরানরে দশ হাজার ট্যাকা দিছি। ই্্্্্উএনও বইলে খাইবে হেই কতা কইয়্যা ট্যাকাটা নিছে।
খোদ্দ বাঁশ পাতার গ্রামের বাসিন্দা আজিজুর এর স্ত্রী সাবিনা ৯২৫) জানান, মুকুলের হাতে পাঁচ হাজার ট্যাকা দিছি। মৃত হাবিবুর রহমানের ছেলে সানাউল বলেন, বেলাল দেওয়ানীর বেটা আলমরে ৫ হাজার ট্যাকা দেওন লাগছে। আলম সেলিম মেম্বারের বন্ধু । ইউএনও, চেয়ারম্যান,মেম্বারদেররে দেওন লাগবো কইয়া সে আমার ট্যাকা লইছে। এ সময় আশ্রয় কেন্দ্রটিতে উপস্থিত ৩০-৩৫ জন পুরুষ-মহিলা সম-শ্বরে বলে ওঠেন , আর কি শুনবেন? প্রত্যেকের কাছ থাইকা একই কতা কইয়া হেরা ট্যাকা নিছে।
এ ব্যাপারে প্রথমে ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার গোলম আজমের সাথে মুঠো ফোনে কথা হলে তিনি বলেন, আমি অসুস্থ। আমি নিজেও টাকা তুলি নাই অন্য কারও দ্বারাও তুলাই নাই। কিন্ত ৯ নং ওয়ার্ডের নতুন মেম্বার সেলিম সে ৫-৬ জন মানুষের মাধ্যমে টাকা উঠাইছে। ইউপি চেয়ারম্যান সোহরাব হোসেন আমকে বলেছে, সেলিম যেন টাকা না তোলে, যাদের নিট থেকে টাকা নিয়েছে সে টাকা যেন দ্রæত ফেরত দিয়ে দেয়। সে কথা আমি সেলিমকে বলেছি। ফেরত দিয়েছে কিনা জানি।
৯ নং ওয়ার্ডের মেম্বার সেলিমের সাথে কথা বললে তিনি এ প্রতিনিধিকে বলেন, এসব তর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। তিনি কারও নিকট থেকে নিজে বা তার কোন লোক দিয়ে টাকা তোলেনি। তবে অভিযোগের তীর যাদের দিকে, মুকুল তার ভগ্নীপতি, জুরান তার ভাই এবং আলম তার বন্ধু বলে স্বীকার করেন।
এ ব্যাপারে অষ্টমীরচর ইউপি চেয়ারম্যান মোঃ সোহরাব হোসেনর নিকট জানতে চাইলে তিনি কথা শুনেই রেগে গিয়ে বলেন, ঐ শুয়োরের ব্চ্চারা আমাকে রিং দিয়া বলে না কেন, কে টাকা চায়? সে কেন, কাকে টাকা দিচ্ছে? আপনাদেরকে যদি বলতে পারে আমি চেয়ারম্যান আমাকে টাকা দেওয়ার আগে কেউ বলে না কেন? আশ্রায়ন কেন্দ্রটি এখনো আনুষ্ঠানিক ভাবে উদ্বোধনই করা হয়নি। আগামী কাল ( আজ মঙ্গলবার) ইউএনওকে নিয়ে যাবও। উদ্বোধন করে লোকজনকে ঢুকিয়ে দেবো। এরই মধ্যে লোকজনকে ঢুকিয়ে দিয়েছে ওরা। আমি ৮ নং ওয়ার্ডের মেম্বার গোলাম আজম বলেছিলাম, যুগ্নীদহের কিছু লোক আমকে অভিযোগ করেছে, সেলিম মেম্বার নাকি টাকা তুলছে। তুমি গিয়ে সেলিম মেম্বারকে বলবে, সে যেন টাকা তোলা বন্ধ করে এবং যার কাছে যে টাকা নিয়েছে তা যেন ফেরত দিয়ে দেয়।এখন তো টাকা রিকোভাবী করা কষ্ট কর। ওখানে যাই দেখি কাইল।
গতকাল মঙ্গলবার চিলমারী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীঘলকান্দি আশ্রায়ন কেন্দ্রে যান উদ্বোধন করতে। এ রির্পোট লেখার সময় তার নাম ও চেয়ারম্যানদের নাম ভাঙিয়ে টাকা তোলার বিষয়টি মোবাইলে জানিয়ে তার মন্তব্য জানতে চাইলে তিনি বলেন, তখন উত্তরে তিনি বলেন, আমার সাথে সেক্সটি নাইন টেলিভিশন চ্যানেলের সাংবাদিক মোঃ আলমগীর হোসেন আছেন। তিনি লোক জনকে এ বিষয়ে জিজ্ঞাসা নাকি করেছিল। কেউ নাকি স্বীকার করেনি।
নির্বাহী কর্মকর্তাকে এই প্রতিনিধি বলেন, গতকাল ওরা যে অভিযোগ করেছে তার ভিডিও রেকর্ড আমার কাছে আছে। তার উত্তরে তিনি বলেন, কেউ কাউকে যেন টাকা না দেয় সে কথা আমি আশ্রিতদেরকে বলেছি। তখন এ প্রতিনিধি, নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মাহবুবুর রহমানকে বলেন, অভিযোগকারীরা বলেছে টাকা তো তারা অনেক আগেই আপনার ও ইউপি চেয়ারম্যানের কথা বলে নিয়েছে। ওখানে প্রায় ৫ লাখ টাকার মতো বাণিজ্য হয়েছে। শুনে তিনি বলেন, ও, তাই নাকি?- আর কোন কথা না বলেই লাইন কেটে দেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *