কলমে -রাধা রানী বিশ্বাস

———————————
বিশ্বমহিম কপালে হাত তুলে শুয়ে আছেন লাইটের আলো থেকে চোখ বাঁচাতে । মা বাবার ছবির দিকে তাকিয়ে মনে মনে বলেন, ” মা,বাবা তোমারা কোথায় চলে গেলে? আমি কি তোমাদের অবাধ্য সন্তান ছিলাম? না তো ! মা তুমি তো প্রায়ই বাবাকে বলতে, ‘আমার ছেলেটা কত লক্ষী! তুমি দেখ, আমার বিশ্ব একদিন অনেক সুনাম করবে। ‘
আমি কি দোষ করলাম মা? তোমরা সবাই আমাকে ফেলে চলে গেলে? আমি কি সবার কাছে পাপ করেছি? তুমি আমার বিয়ে নিয়ে কত স্বপ্ন দেখতে?
ঝুমকাকে দেখেই বলতে, ‘তোর জন্য এমন সুন্দর একটা মেয়ে খুঁজব। ‘ আমি বলতাম, ‘তোমার কি ঝুমকাকে খুব পছন্দ?’
তুমি কথা এড়িয়ে চলে যেতে। আমি কিন্তু তোমার মনের কথা বুঝতাম । অথচ দেখ! আমি অবিবাহিত রয়ে গেলাম। আর ঝুমকা চলে গেল তোমাদের সাথে।” একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেন।
পরক্ষণেই মনে পড়ল, যুদ্ধে যাওয়ার একদিন আগে তিন বন্ধু মিলে মাঠে বসেছিলেন । ঝুমকা,বিশ্বমহিম আর তরণী। ঝুমকা বিশ্বমহিম আর তরণীকে অনেক অনুরোধ করেছিল “তোমরা আমাকেও যুদ্ধে নিয়ে চল। অনেক মেয়েরা যুদ্ধ করছে। আমি গেলে দোষ কোথায়? ”
কত আকুতি করেছিল ঝুমকা । কত ভাবে বুঝানোর চেষ্টা করেছে তাদের । বিশ্বমহিম চোখে ইশারা দিয়ে তরুণীকে বলে দিয়েছে,
” তরণী তুই রাজি হবি না। তোকে রাজি করতে পারলে আমাকে আক্রমণ করবে ঝুমকা যাওয়ার জন্য । ”
তরণী বারবার বলছে, “ঝুমকা তুই বুঝতে চেষ্টা কর। তোকে নিয়ে গেলে আমরা বিপদে পরব। ”
ঝুমকা বলল,”তোরা আমাকে না নিয়ে গেলে আমি বিপদে পড়ব তরণী। ”
তরণী ভ্রু কুচকে বলল, “তোর আবার কিসের বিপদ? ”
ঝুমকা চুপ থেকে বলল,”আমার বিয়ের কথা চলছে। ”
বিশ্বমহিম দুহাত ঘাসের উপর ভর দিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছিল।
এবার নড়েচড়ে বসছে। কথাটা শুনে বুকের ভিতর ভেঙেচুড়ে
যাচ্ছে । তবুও স্বাভাবিক রইলেন ।
দৃঢ়ভাবে ঝুমকাকে বলল, ” কোন ভাবেই তোমাকে নেওয়া যাবে না। তরণীর অসুস্থ বাবা আর মা একা। আমাদের বাড়িতে গহনা আছে। তুমি থাকলে বুদ্ধি দিয়ে হলেও সাহায্য করতে পারবে। ”
ঝুমকা বিচ্ছেদের সুর বুঝে গেছে । হাটুতে চিবুক ঠেকিয়ে বসেছিল ঝুমকা,খোলা মাঠে ঘাসের উপর বিশ্বমহিমের সামনে। তার ফর্সা গাল বেয়ে কাজল গুলিয়ে চোখের জল নামছে। বিশ্বমহিম এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ঝুমকার দিকে ।
তরণী উঠে গেল। এক আঙুল দেখিয়ে ইশারা করে বলল,”একদিন পরে তারা চলে যাবে যুদ্ধে।” তরণী চলে যাওয়ার পর ঝুমকার মাথায় হাত রাখলো মহিম। ঝুমকা হাউমাউ করে কেঁদে উঠলো । বিশ্বমহিম দাঁড়িয়ে এক হাতে টেনে তুলল ঝুমকাকে ।
বিশ্বমহিম নিচু সুরে বলল,” আস্তে! আস্তে! কেউ শুনে ফেলবে । চারিদিকে মানুষ দেখতে পাচ্ছ না? ”
এই কথা বলেই ঝুমকার হাত ধরে সামনের দিকে এগিয়ে
গেল । ঝুমকা পাশাপাশি হেঁটে যাচ্ছে আর ফুপিয়ে কাঁদছে ।
বিশ্বমহিম পকেট থেকে রুমালটা বের করে এগিয়ে দিল।
একটানে রুমালটা নিয়ে রাগে রাগে চোখ মুছলো ঝুমকা । বিশ্বমহিম তাকে অনেক কথা বলে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করল । কিন্তু কিছুই বুঝতে পারলো না ঝুমকা আসলে বুঝল কি-না । নাকি মানতে পারছে না তার কথা গুলো । সে কোন কথাই বলছে না ।শুধু হাত ধরে হাঁটছে ।
বিশ্বমহিম একটা চাপা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, নিজের চামড়া কুচকানো হাতটা চোখের সামনে ধরে আছে। আর একটা আঙুল দিয়ে আর একটা আঙুল ছুঁয়ে দেখছেন।
“এই হাতটা দিয়ে আমি ঝুমকার কোমল হাতটা ধরে ছিলাম । এই হাত দিয়ে কত রক্ত ঝরিয়েছি দেশের জন্য ।”
ঝুমকার ছোঁয়া অনুভব করার জন্য হাতের তালুতে অন্য হাত দিয়ে স্পর্শ করছেন । এই শীতের মধ্যে দুফোটা গরম জলের ধারা এসে পড়ল হাতের কব্জিতে ।
লাঠিতে ভর দিয়ে আলমারিটার কাছে গিয়ে আস্তে আস্তে খুললেন । বাক্স খুলে গহনার চিঠিটা বের করলেন । কিছুক্ষণ ছুঁয়ে দেখে রেখে দিলেন । চিঠির কাগজটা বাদামী হয়ে গেছে । ফাউন্টেন কলম দিয়ে লেখা গুলো ছড়িয়ে গেছে।
চোখের সমস্যার কারনে ভালো করে পড়তে পারেন না। তাই হাত বুলিয়ে রেখে দেন।
লাইটের আলোতে স্বর্ণের মত চিকচিক করছে একটা জিনিস । বিশ্বমহিম ভুলেই গিয়েছিলেন এই জিনিসটার কথা ।
হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখতে লাগলেন। এমন সময় ঠাস করে নিচে পড়ে গেল জিনিসটা, পিতলের সিঁদুরের কৌটা । ঘরের মেঝেতে পড়ে ঢাকনা খুলে গেল । লাল টকটকে সিঁদুর
ছড়িয়ে পড়ল ঘরের মেঝেতে।
সিঁদুর দেখে বিশ্বমহিম আঁতকে উঠলেন ।
চোখের সামনে পুরনো স্মৃতির আলোর ঝলকে চোখ দুটো ঝলসে যাচ্ছে ।
গহনার সাহায্য নিয়ে রাতে বিশ্বমহিম বের হয়েছিলেন চাদর মুড়ি দিয়ে নিজেকে আড়াল করে নিয়ে। বকুল তলা গিয়ে একটু থামলেন । তরণী বের হতে পেরেছে কিনা দেখতে লাগলেন পিছনে ফিরে ।
হঠাৎ করে একটি নারী ছায়া মূর্তি এসে দাঁড়াল তার সামনে।
বিশ্বমহিম চমকে উঠলেন, “তুমি! ঝুমকা তুমি এখানে ! ”
কিছু বুঝে উঠার আগে ঝুমকা বিশ্বমহিমকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে উঠল। বিশ্বমহিম তার চাদর দিয়ে ঝুমকাকে আড়াল করে ফেললেন যাতে কেউ দেখে না ফেলে এই ভয়ে।
ঝুমকার কান্না মিশ্রিত গরম নিঃশ্বাস তার বুকে টের পেলেন ।
এখন কি করবে বিশ্বমহিম ভাবতে পারছেন না ।
পিতলের চকচকে সিঁদুরের কৌটাটা ঝুমকা বিশ্বমহিমের সামনে ধরে বলল,” মহিম!হয় আমাকে তুমি সিঁদুর পড়িয়ে রেখে যাবে নইলে আমার মৃত্যুর খবর তোমাকে শুনতে হবে। ”
বিশ্বমহিম ফিসফিস করে বললেন, “শান্ত হও ঝুমকা ।”
ঝুমকার হাত থেকে কৌটাটা নিলেন। মনে মনে দ্রুত স্থির করলেন সিঁদুর সিঁথিতে দিয়ে দিবেন। যা আছে কপালে!
হঠাৎ গুলির শব্দ । এদিকেই এগিয়ে আসছে শব্দটা ।
তরণীর গলা “বউ কথা কও……” একবার, দুবার……. তিন হওয়ার পরেও শিষ দিয়ে দৌড়াচ্ছে “বউ কথা কও…….। ”
তরুণী বিশ্বমহিমকে সংকেত দিয়ে বুঝিয়ে দিল কোন পথে
যাচ্ছে সে । যে পথে যাওয়ার কথা ছিল সে পথে যেতে পারবে না। গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে ।
বিশ্বমহিম সিঁদুরের কৌটাটি আর খুলতে পারলেন না।
“ঝুমকা পালাও! বেঁচে থাকলে ফিরে আসব। ”
এই কথা বলে সিঁদুরের কৌটা হাতে নিয়েই দৌঁড়ালেন।
ঝুমকা স্তব্ধ হয়ে কয়েক মুহূর্ত দাঁড়িয়ে রইল । এরপর গহনার কাছে আশ্রয়ের জন্য দৌড় দিল। গহনা পর্দার আড়ালে দাঁড়িয়ে ছিল তরণীর জন্য । সমস্ত দৃশ্য সে দাঁড়িয়ে দেখেছে।
কষ্টের কান্নাটা নিজের হাতে মুখ চেপে রোধ করল।
দৌঁড়ে নিচে গিয়ে গেট খুলে দিল । সারারাত লুকিয়ে রেখে ভোর রাতে পৌঁছে দিল ঝুমকাকে ।
এতকিছু ঘটে গেল দুই বাড়ির কেউ জানল না। কি হয়ে গেল।
সকালে “বিশ্ব….. বিশ্ব…” বলে বিশ্বমহিমের মা ছেলের ঘরে আসলেন। দরজা খোলা দেখে আর বুঝতে বাকি রইল না
তার ছেলে যুদ্ধে চলে গেছে । গহনার ঘরে টোকা দিতেই গহনা নিচের দিকে তাকিয়ে দরজা খুলে দিল । সারারাত কান্না করেছে গহনা,চোখের পাতা ফুলে আছে । চোখের অবস্থা দেখে তার মা বুঝতে পেরেছেন তার মেয়ে গহনা পুরো বিষয়টা জানে । বিশ্বমহিম যুদ্ধে যাওয়ার পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সবকিছু । মহিমের মা ঠাস করে মেয়ের গালে চড় বসিয়ে দিলেন । মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে কাঁদতে মেঝেতে বসে পরলেন ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *