– নাজমুল হুদা পারভেজ

প্রসংগে যাবার পূর্বে যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই তা হলো সাংবাদিক আগে , না, প্রেসক্লাব আগে। কোন টা আগে? কিংবা পত্রিকা আগে না, সাংবাদিক আগে?
দ্বিতীয় প্রশ্নটা থেকে শুরু করা যাক। আসলে পত্রিকা বা মিডিয়া না হলে সাংবাদিকের জন্ম হতো না। মিডিয়া কি বা গণমাধ্যম কি? আমার মতে, যে মাধ্যমে মানুষের সমস্যা, সম্ভাবনা, অর্থনৈতিক বিষয়, অন্তরায়, সমস্যা উত্তরণের উপায়, পৃথিবীর সকল বস্তু , জীব ও পরিবেশের তথ্য বস্তনিষ্ঠ উপস্থাপনের মাধ্যম, যে মাধ্যমে জীবন-জীবিকার কথা , অন্যায়, জুলুম, নির্যাতন, র্দূনীতি, আইনে বলবৎযোগ্য নয় এমন সামাজিক কর্মকান্ডের ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের তথ্য বহুল ও নির্ভরযোগ্য উপস্থাপন করা হয় তাকেই আমরা গণমাধ্যম বলতে পারি। এটা সংক্ষিপ্ত রুপ। এটাকে আরো বিষদ ভাবে এবং আরো গভীরে উপস্থাপন করা যেতে পারে। আমার এই লেখার লক্ষ্য সেটা নয়। তাই আমি বিষদ ব্যাখ্যা পরিহার করে মুল কথায় আসতে চাই। এক কথায় যে মাধ্যমে সংবাদ ভাষ্য জনগণের নিকট পৌঁছানো হয় -সেটাকেই আমরা গণমাধ্যম বলতে পারি।
তাহলে এই মাধ্যমে কাজ করার জন্য অথাৎ উপরোক্ত বিষয় গুলি গণমাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য কিছু মানুষকে বিষয় ভিত্তিক কাজ করতে হবে। ইংরেজিতে Journal এবং Ism এই দুটি শব্দের সমন্বয়ে Journalism শব্দের সৃষ্টি। এর আভিধানিক অর্থ সাংবাদিকতা। ড. পার্থ চট্টোপধ্যায়ের মতে“ সাংবাদিকতা চলমান জীবনের শব্দময় প্রতিচ্ছবি, যা কখনো মন্ময় কখনো বস্তুনিষ্ঠ। সাংবাদিকতা এই প্রতিচ্ছবিকে আপন হৃদয়ে ধারণ করে তাকে আবার সাধারণ মানুষের কাছে ফিরিয়ে দেবার এক জটিল পদ্ধতি। সাংবাদিকতা বস্তুনিষ্ঠ,সাহিত্য ও দ্রুত লয়ের ইতিহাসের সংমিশ্রণ। সাংবাদিকতা জীবন, সমাজ ও রাষ্ট্রের গতি প্রকৃতি বর্ণনার এক প্রকৌশল”।

এই সংজ্ঞা থেকে আমরা বুঝলাম সাংবাদিকতার কাজটি করতে হলে গণমাধ্যম আগে পরে সাংবাদিক। এখন আসা যাক, প্রথম প্রশ্নটায়। প্রথম প্রশ্নটার একটি অংশের উত্তর আমারা পেয়ে গেছি । সেটা হলো, গণমাধ্যম থেকে সাংবাদিকের জন্ম। প্রেসক্লাব থেকে বা কোন সাংবাদিক সংগঠণ থেকে সাংবাদিকের জন্ম হয় না। তাহলে প্রেসক্লাব বা সাংবাদিক সংগঠণ গুলো কি? প্রেসক্লাব কিংবা সাংবাদিক সংগঠণ হলো সাংবাদিকদের ক্লাব বা চিত্তবিনোদনের জায়গা। এখানে বিভিন্ন গণমাধ্যমের কর্মীরা বিনোদনের জন্য আসবে । এতে প্রত্যেকের সাথে প্রত্যের হৃদ্যতা গড়ে উঠবে এবং সাংবাদিকদের যে কোন সমস্যায় তারা ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে আসবে।

প্রেসক্লাব সাংবাদিককে চালায় না বা তৈরীও করে না। সাংবাদিককে চালয় পত্রিকা। সাংবাদিকরা চালায় প্রেসক্লাব। সুতরাং প্রেসক্লাবের নিকট কোন সাংবাদিক দায়বদ্ধ নয়। অনেক অফিস, ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠান তাদের কোন সংবাদ প্রকাশের জন্য শুধু প্রেসক্লাবের সভাপতি কিংবা সেক্রেটারীকে আহব্বাণ জানান। তাদের ধারনা সভাপতি বা সেক্রেটারী এলেই বুঝি আমার সংবাদটি বাংলাদেশের সব মিডিয়ায় চলে আসবে। আগেই বলেছি, প্রেসক্লাব সাংবাদিকতা নিয়ন্ত্রণ করে না। সুতরাং কোন সংবাদ একাধিক মিডিয়ায় আনতে হলে, আপনি কোন কোন মিডিয়া চান , সেই মিডিয়ার সাংবাদিক বা প্রতিনিধিকে পৃথক পৃথক ভাবে আহব্বাণ জানাতে হবে এবং সংবাদের বিষয়টি জ্ঞাত করাতে হবে। এখানে বলে রাখি ,সব ঘটনাই কিন্ত সংবাদ নয়। এখানে সংশ্লিষ্ট সাংবাদিক যদি মনে করেন ্এটা গণমাধ্যমে প্রকাশ যোগ্য এবং সংবাদ। তবেই তিনি সেই বিষয়টির উপর সংবাদ তৈরী করে তার পত্রিকা বা সংশ্লিষ্ট গণমাধ্যমে প্রকাশ করবেন।
বাস্তবতা হলো প্রেসক্লাবের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদক কোন কোন মিটিং থেকে ফিরে প্রেসক্লাবভুক্ত সকল সাংবাদিককে একটি নিউজ তৈরী করে দিয়ে যার যার গণমাধ্যমে পাঠানোর জন্য অনুরোধ জানাতে পারে। কিন্ত আদেশ করতে পারে না। আবার অনুরোধ জানালেই যে, আরেকজন সাংবাদিক কিছু না জেনে সভাপতি বা সেক্রেটারীর দেয়া তথ্যের উপর ভিত্তি করে তার পত্রিকায় সংবাদ করবে, সেটা নাও করতে পারে। কারন সাংবাদিকতা সেকথা বলে না। সাংবাদিকতা অন্য কথা বলে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সভাপতি বা সেক্রেটারী কোন অনুষ্ঠাণে আমন্ত্রিত হয়ে গিয়ে ফিরে এসে, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রেসক্লাব ভ‚ক্ত অন্যান্য সাংবাদিককে জানায় না। সেকারণে সংবাদটি একাধিক পত্রিকা বা গণমাধ্যমে আসে না। যে কথাটি বলে প্রথম পর্বের আলোচনা শেষ করতে চাই, সেটা হলো কোন সংবাদ ব্যাপক প্রচারের প্রয়োজন হলে শুধু প্রেসক্লাবের সভাপতি বা সেক্রেটারীকে আহব্বাণ জানালে আপনার মুল উদ্দেশ্য পুরণ হবে না। আপনাকে আপনার এলাকার গুরুত্বপূর্ণ মিডিয়ার সকল সাংবাদিককে পৃথক পৃথক ভাবে আহব্বাণ জানাতে হবে। আর মনে রাখবেন কোন সাংবাদককে প্রেসক্লাব নিয়ন্ত্রণ করে না বরং প্রেসক্লাবকে সাংবাদিকরাই নিয়ন্ত্রণ করে। প্রেসক্লাব সরকারের নিবন্ধনকৃত কোন প্রতিষ্ঠাণ নয়। কিংবা জাতীয় প্রেসক্লাব বিভাগীয় প্রেসক্লাবকে, অথবা বিভাগীয় প্রেসক্লাব জেলা প্রেসক্লাবকে কিংবা জেলা প্রেসক্লাব উপজেলা পর্যায়ের প্রেসক্লাবকে নিয়ন্ত্রণ করে না। এ জগতে কোন চেইন অব কমান্ড নেই। এসব সংগঠণ এলাকা ভিত্তিক সাংবাদিকরা নিজেদের প্রয়োজনে গড়ে তোলে। এসব সংগঠণের আইনগত কোন ভিত্তিও নেই।কারণ এই সল সংগঠণের গঠণতন্ত্র বা সংবিধান তারা নিজেরাই তৈরী করে। এবং তা সরকারের কোন দপ্তর থেকে অনুমোদন নিতে হয় না। তবে পত্রিকা ও সাংবাদিক এদুটি বিষয়ের আইনগত ভিত্তি আছে। পত্রিকা ও সাংবাদিকতাকে একটি রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়।

বাংলাদেশের বিশিষ্ট কলামিষ্ট আব্দুল মান্নান এর মতে, স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চর্তুথ স্তম্ভ বলা হয়। থমাস জেফারসন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মূল রচনাটিও তিনি করেছিলেন। জেফারসন ছিলেন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সর্বাধিক গুরুত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে একজন প্রবাদপুরুষ। তিনি একবার বলছেলেন, ‘আমাকে যদি এই বিকল্পটি দেওয়া হয় যে তুমি কি সংবাদপত্রবিহীন সরকার চাও, না সরকারবিহীন সংবাদপত্র চাও? তখন আমি পরেরটা বেছে নেব।’ জফোরসন বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ ও সংবাদপত্রের কথা বলেছিলেন। ঠিক তাঁর প্রায় ৫০ বছর পর ফরাসি সম্রাট নেপোলিয়ন বোনার্পাট সংবাদপত্র সর্ম্পকে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছিলেন, চারটি আক্রমণাত্মক সংবাদপত্র হাজারটা বেয়নেটের চেয়েও ক্ষতিকর। “র্অ্থনীতিবীদ অর্মত্য সেনের মতে কোনো দেশে স্বাধীন গণমাধ্যম থাকলে সে দেশে র্দুভিক্ষ হানা দিতে পারে না। যুগ যুগ ধরে মানুষ সংবাদ, সংবাদপত্র, স্বাধীন গণমাধ্যমের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে , আবার এটিও উপলব্ধি করেছে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা যদি সঠকিভাবে ব্যবহার করা না হয় অথবা সংবাদমাধ্যম যদি কোনো দুরভিসন্ধি নিয়ে অসত্য বা র্অধসত্য সংবাদ প্রচার করে তা দেশ, জাতি ও সমাজের ক্ষতির কারণ হতে পারে।
দ্বিতীয় পর্বে সারাদেশে প্রেসক্লাব গুলোতে বিভক্তি কেন সে বিষয়ে আলোচনা করার ইচ্ছে থাকলো।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *