মিহির ভোসলে:
যেকোনো যুদ্ধেরই চূড়ান্ত ফলাফলে এক পক্ষের জয় হয়, অন্য পক্ষ নতমস্তিস্কে পরাজয় বরণ করে নেয়। কিন্তু রয়ে যায় যুদ্ধের রেশ। যুদ্ধের সঙ্গে জড়িত হাজারো-লাখো মানুষের মনে হয়তো আনন্দের ক্ষণ কিংবা বিষাদের ইতিহাস হয়ে বারবার উঠে আসে যুদ্ধকালীণ স্মৃতি।

এবার মহা ধুমধামের সঙ্গে উদযাপিত হলো বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫০ তম বিজয় দিবস। ভারত ও বাংলাদেশ উভয় রাষ্ট্রেই দেশজুড়ে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে দিনটি স্মরণীয় করে রাখা হয়েছে। বিশেষ এই মুহূর্তে নিজেদের অনুভূতি ব্যক্ত করেছেন ১৯৭১ এর যুদ্ধের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা প্রাক্তন সেনানী ও স্বেচ্ছাসেবীগণও।

তেমনই একজন ভারতীয় নৌবাহিনীর প্রাক্তন কমান্ডার অজয় কুমার রায়। গুজরাটের পশ্চিম উপকূলে ভারতীয় নৌ জাহাজ কৃষ্ণ-তে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে বলতে গিয়ে অবসরপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তা বলেন, “গোটা মার্চ জুড়েই উত্তাল সময় পার করলেও, বাঙালীর অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে যাবার পরই যুদ্ধের আবহ তৈরী হয়েছিলো। আমরা সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করে রেখেছিলাম। কিন্তু ভারতীয় সেনা, নৌ এবং বিমানবাহিনী, সবাই অত্যন্ত সতর্ক অবস্থায় দিনাতিপাত করছিলাম। অক্টোবরে বর্ষা শেষ হবার কিছু সময় পরই পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমরা।”

অজয় রায় আরও বলেন, “তবে আমরা অপেক্ষায় ছিলাম। ০৩ ডিসেম্বর যখনই পাকিস্তানের বিমান বাহিনী আমাদের পশ্চিম সেক্টরে প্রায় ১০-১২ টি ভারতীয় বিমানে বোমাবর্ষণ করে, তখন আর সরাসরি যুদ্ধ না করে উপায় ছিলো না।”

সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হবার পরই ০৪ এবং ০৫ ডিসেম্বর রাতে ভয়াবহ পরিস্থিতির তৈরী হয় বলে জানান অজয় রায়। তিনি বলেন, “গুজরাট উপকূলে টহলরত তিনটি ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ ভীষণ দক্ষতার সঙ্গে তিনটি পাকিস্তানি যুদ্ধজাহাজ ডুবিয়ে দেয়। তাছাড়া, পাকিস্তানের আরও কয়েকটি সহযোগী জাহাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে সক্ষম হই আমরা।”

যুদ্ধকালীণ পরিস্থিতির বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রাক্তন এই নৌ কর্মকর্তা আরও জানান, “০৯ এবং ১০ ডিসেম্বর আমাদের জাহাজ থেকে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করা হয়। হামলার ফলে করাচি তেল শোধনাগার অবধি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এছাড়া, দিনের আলোতেই পাকিস্তানের পুরো পোতাশ্রয় শহরকে ধোঁয়ায় নিমজ্জিত দেখতে পাই আমরা।”

অজয় রায় আরও যোগ করেন, “আমাদের জাহাজে বিশুদ্ধ জল একেবারেই ছিলো না। খাবার সঙ্কটেও ভুগছিলাম আমরা। প্রায়ই শুধুমাত্র চাপাতি ও খিচুড়ি খেয়ে দিনাতিপাত করেছে আমাদের ক্রু মেম্বারগণ। যুদ্ধ আমাদের মনের ভেতরও সংঘটিত হচ্ছিলো। তবে পুরো সময়টায় আমাদের মনোবল ছিলো ভীষণ দৃঢ় ও উচ্চ।”

তবে সম্পূর্ণরূপে যুদ্ধবিরতি ঘোষণার পরও ১৬ ডিসেম্বর নাগাদ ভারতীয় জাহাজগুলো মুম্বাই ফিরে যায় বলেও জানান অজয়। তবে তাঁদের জাহাজটি ফিরতে প্রায় ২০ তারিখ অবধি সময় নেয় বলে স্মৃতিচারণ করেন তিনি।

কথা হয় যুদ্ধের আরেক সেনানী ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রাক্তন উইং কমান্ডার আনন্দময় বাগচির সঙ্গে। পাঠানকোট এয়ার ফোর্স স্টেশনে টেকনিক্যাল সাপোর্ট ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে রেডিও কমিউনিকেশন দেখাশোনা করতেন তিনি। বাগচি বলেন, “যুদ্ধকালীন সময়, বিশেষত ০৩-১৬ ডিসেম্বর অবধি পরিস্থিতি ছিলো রক্ত হিম করা। আমরা অনেকদিন যাবতই যুদ্ধের প্রত্যাশায় উচ্চ সতর্ক ছিলাম। লম্বা সময়ের অপেক্ষা আমাদের যেনো কাবু করে ফেলছিলো। তবে ০৩ তারিখে যেই না পাকিস্তান আমাদের বিমানঘাঁটি গুলোতে হামলা শুরু করলো, সেনাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এলো। যাক, অবশেষে যুদ্ধ শুরু হলো!”

স্মৃতিচারণ করে আনন্দময় বাগচি আরও বলেন, “যখনই পাক বাহিনী হামলা করতো, আমি ও আমার সহকর্মীরা বাঙ্কারে আশ্রয় নিতাম। অনেক সময় একসাথে অনেক হামলার সম্মুখীন হতে হতো আমাদের। এমনকি কভার করার সময়ও পেতাম না। সেই সময়গুলো সত্যিই গাঁ ঠান্ডা করার মতো।”

যুদ্ধকালীন অভিজ্ঞতা জানতে দ্বারস্থ হই প্রাক্তন ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল অবসরপ্রাপ্ত শশাঙ্ক রায় চৌধুরীর। ৭১ এ যুদ্ধকালে ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন মেজর হিসেবে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যোগসূত্রতা ছিলো তাঁর।

মুক্তিযুদ্ধকালীন গোটা সময়কে অত্যন্ত জটিল ও বিভ্রান্তিকর আখ্যা দিয়ে জেনারেল রায় বলেন, “মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় সেনাগণ বলতে গেলে একই বাহিনীর দুটো অঙ্গ হিসেবে কাজ করে। আক্ষরিক অর্থে যুদ্ধ শুরুর আগ অবধি আমরা মুক্তিবাহিনীতেই ছিলাম।”

জেনারেল রায় আরও বলেন, “আমাদের উপর নির্দেশনা ছিলো পাক বাহিনীর উপর আক্ষরিক অর্থে চাপ বজায় রাখার এবং সম্ভব সর্বোচ্চ ক্ষতিসাধনের, যাতে তাঁদের মনোবল ভেঙ্গে যায়। সেজন্য আমরা মুক্তিযুদ্ধাদের গেরিলা যুদ্ধের প্রশিক্ষণ দেয়া আরম্ভ করি এবং গেরিলা যুদ্ধ শুরু করি। তবে কারুর দেশের অভ্যন্তরে গিয়ে তাঁকে হয়রানি করা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ আমাদের পক্ষে ছিলো। তাই ব্যাপারটি সহজ হয়ে উঠে। সর্বোপরি, ১৯৭১ এর যুদ্ধ একটি গণযুদ্ধের ক্লাসিক কেস ছিলো।”

স্মৃতিচারণায় সাবেক ভারতীয় সেনাপ্রধান যোগ করেন, “যতদিন আমরা মুক্তিবাহিনীতে ছিলাম, আমাদের জন্য সাধারণ পোশাকে চলাফেরা করা বাধ্যতামূলক ছিলো। কারণ আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে তখনও যুদ্ধ আরম্ভ হয়নি এবং সহজেই আমরা রাজাকারদের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হবার আশঙ্কা ছিলো। তবে যেই না যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক ঘোষণা এলো, আমরা ইউনিফর্মে ফিরে আসি এবং মূলধারায় যুদ্ধ আরম্ভ করি।”

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ -এ সহযোগীদের সাথে যশোরে অবস্থান করছিলেন বলেও জানান জেনারেল রায়। বর্ষীয়ান এই প্রাক্তন সেনা কর্মকর্তা বলেন, “ভারতীয় সেনাবাহিনী ঢাকা দখলের পর বিশাল এক কুচকাওয়াজের আয়োজন করে। আমি যশোর থেকেই খবর পাই। তখন আমি আমার মুক্তিবাহিনীর সহযোগিদের সাথে যশোর শহরের কোনো এক গাছতলায় বসেছিলাম।”

তবে ভারতীয় সেনানীদের গৌরবময় অর্জনের খবর পেয়ে অত্যন্ত আনন্দিত হয়ে পড়েন বলে জানান রায়। তিনি যোগ করেন, “স্মরণে আছে, আমি সাধারণ পোশাক পরিহিত ছিলাম। রেডিও চালু করেছিলাম সব শোনার জন্য। কিন্তু রেডিওটা ভালোভাবে কাজ করছিলো না। তবে এটুকু শুনতে পাই যে, ভারতীয় সেনাবাহিনীর ১৬ তম প্যারাসুট ব্রিগেড গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।”

লেখক: মিহির ভোসলে, এসিস্ট্যান্ট এডিটর, ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক
অনুবাদ: ফাহিম আহম্মেদ মন্ডল, ইন্ডিয়া নিউজ নেটওয়ার্ক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *