রচনা: আব্দুল খালেক ফারুক
ইতুর নিখেঁাজ হবার প্রায় এক সপ্তাহ হয়েছে। কোথাও খোঁজ খবর পাওয়া যায়নি। ঘোড়া ফকিরের দেয়া তাবিজের কোন রিয়াকশন আপাতত দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না। সরকারি দলের বেশ কয়েকজন নেতার সাথে কথা বলেছেন। এদের মধ্যে পুলিশ মহলে বেশ খায় খাতির আছে এমন নেতাও ছিলেন। কিন্তু কেউ সঠিক কোন তথ্য দিতে পারেননি। ছেলের কারণে ইতুর মা এখনও শয্যাশায়ী। দিনে দিনে তার অবস্থা খারাপ হচ্ছে।
শামসুল আলমের পরামর্শে একজন সাংবাদিকের সাথে সাক্ষাৎ করতে গেলেন দু’জন। পত্রিকায় ইতুর হঠাৎ গায়েব হয়ে যাওয়ার সংবাদটি প্রকাশিত হলে যদি কোন ক্লু পাওয়া যায়—এই আশায়। শামসুল আলম এখন যে সাংবাদিকের বাসায় নিয়ে এলেন রইচ উদ্দিনকে—তার নাম কুদ্দুছ প্রামানিক।
এই সাংবাদিক একটি জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় কাজ করেন। পত্রিকার নাম ‘আপেনটি বাইস্কোপ’। তার নিজের একটি দৈনিক আছে। নাম ‘হাবিজাবি সংবাদ’। আর ‘কারেণ্ট খবর’ নামে একটি অনলাইনের প্রতিনিধি হিসেবে পরিচিতি দেয়া রয়েছে বাসার সামনে ঝোলানো সাইনবোর্ডে।
বিরাট আকারের সাইনবোর্ডটিতে আরো কয়েকটি সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধি হিসেবে তার নাম স্বণার্ক্ষরে লেখা রয়েছে। রয়েছে তার পুরষ্কার—পদক পাবার বিবরণ। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে হাস্যজ্জ্বোল ছবি। সাইনবোর্ডের সর্বডানে রয়েছে একটি কলমের ছবি। রাউন্ড দিয়ে লেখা রয়েছে ‘সাংবাদিকের কলমের কালি শহীদের রক্তের চেয়েও পবিত্র’। বামে মহাপুরুষদের কিছু কোটেশন। সবমিলে তার সাইনবোর্ডটি একটি জীবন্ত উইকিপিডিয়া! বেশ সময় নিয়ে পড়তে হয়। পাশে আবার ‘প্রেসক্লাব’ নামের আরেকটি সাইনবোর্ড। এটা এই শহরের কততম প্রেসক্লাব কে জানে।
রইচ উদ্দিন এই সাইনবোর্ডের লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। এক সময় খেয়াল করলেন তার চোখ টনটন করছে। আজকাল রাস্তা দিয়ে চলতে গেলে হাজার রঙের সাইনবোর্ড নজরে আসে। পড়তে গেলেই চোখের উপর চাপ পড়ে। বয়সতো কম হলোনা।
শামসুল আলম শুনেছেন নৈতিক স্খলনের কারণে কাউকে প্রেসক্লাব থেকে বহিস্কার করলে তিনি নিজেই প্রেসক্লাব খুলে বসেন। আর অনেক সময় নীতিগত বিরোধের কারণে বিভক্তি ঘটে। সব জায়গায় বিভক্তি। তার থেকে সাংবাদিকরা ব্যতিক্রম হবেন কেন?
পূর্ব পরিচয়ের সূত্র ধরে রইচ উদ্দিনকে নিয়ে এসেছেন তার কাছে। পৌরসভায় চাকুরি করার সময় এই সাংবাদিককে প্রায়ই মেয়রের রুমে ঘুর ঘুর করতে দেখেছেন।
সাংবাদিক সাহেবকে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি হয়তো বাসার ভেতর থেকে এখনই আসবেন। ভাবতে ভাবতেই বেশ মোটাতাজা স্বাস্থ্যবান একজন ‘সাংবাদিক’ বেরিয়ে এলেন বাসা থেকে। তার চোখ এখনো ঢুলুঢুলু। রাত জেগে ‘ষ্টাডি’ করতে করতে এই অবস্থা।
ইদানিং বিভিন্ন স্থানে জুয়ার আসর বসছে। রাতভর ‘সরেজমিন অনুসন্ধান’ করতে হয় জুয়ার আসরে গিয়ে। আসরে কিছু বখরা নিয়ে বাসায় ফিরতে গিয়ে রাত কাবার হয়ে যায়। কয়েকজন পুলিশ সদস্যকেও সিভিলে দেখা যায় সেখানে। নাইট চুক্তির টাকা বুঝে নেন তারা। দর কষাকষি করতে গিয়ে জুয়ারিদের হাতে দু’ একবার ধোলাই খেতেও হয়েছে কুদ্দুছকে। এসব টপ সিক্রেট ব্যাপার। অনেকেই জানেননা। সবাই যেটা জানে তা হলো—কুচ্ছুস প্রামাণিক একজন ডাকসাইটে আর প্রভাবশালী সাংবাদিক।
কুদ্দুছ প্রামানিকের উত্থানপর্বটাও কামেল পীর ফকিরের কাহিনীর মতোই চমকপ্রদ। শহরের কাপড় পট্রিতে ছিল তার একটি ছোট কাপড়ের দোকান। পুঁজি বেশী ছিলনা। গ্রামের বাড়িতে কিছু টাকা সুদে খাটাতেন। স্যান্ডো গেঞ্জি আর জাঙিয়া বেচতে বেচতে সাংবাদিক হওয়া—বিরল প্রতিভা না থাকলে সেটা যে সম্ভব না— বুঝিয়ে দিয়েছেন কুদ্দুছ।
‘চলেন ভিতরে চলেন’—সাংবাদিক সাহেবের হাকডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলেন রইচ উদ্দিন।
বাসার ভেতরে একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হলো তাদেরকে। একটি গদিওয়ালা চেয়ারে আয়েশ করে বসলেন সাংবাদিক। সামনে একটি টেবিল। কয়েকটি চেয়ার আর একটি ষ্টিলের র‌্যাক রয়েছে রুমে।
‘বলেন আপনাদের আগমনের হেতু কী?
শামসুল আলম সাহেব সংক্ষেপে ইতুর অন্তধার্ণ সম্পর্কে জানালেন কুদ্দুছকে।
‘আপনার কাছে অনেক আশা নিয়ে এসেছি সাংবাদিক সাব। আমার ছেলেকে খুঁজে পেতে সাহায্য করুন’।
পার্টির নতজানু দশা দেখে ভাব নিলেন কুদ্দুছ। এবার তার ক্ষমতা সম্পর্কে পার্টিকে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়ার পালা।
‘আপনারা সঠিক জায়গাতে এসেছেন। চিন্তার কোন কারণ নাই। আমি যা পারবনা কোন সাংবাদিকের বাবার ক্ষমতা নাই সেটা করে। প্রশাসন বলেন—পাবলিক বলেন সবাই আমাকে যমের মতো ভয় পায়। কেন ভয় পায় জানেন? আমি শুধু কলম সৈনিক নই। কলমের জোর আগের মতো নাই। ধার কমে গেছে। লিখলেও কাজ হয় না। তাই ডাইরেক্ট এ্যাকশনে যাই’।
্ এ কথা বলেই একটি ঝোলা ব্যাগ বের করেন ড্রয়ার থেকে। সেই ব্যাগ থেকে প্রথমে বের করলেন একটি ছোট সনি ক্যামেরা। দেখে মনে হলো এর উপর দিয়ে বেশ ধকল গেছে। কয়েক জায়গায় ফেটে গেছে। ক্যামেরার দৈন্যতা ঢাকতে স্কচটেপ আর ষ্টিকার লাগানো হয়েছে ফাটা জায়গায়। এরপর বের করে আনলেন একটি ছোট্র হকিষ্ট্রিক। পরে পুলিশের অফিসাররা ব্যবহার করেন এমন ধরণের ছোট লাঠি। যার দু’দিকেই তামার পাত লাগানো। তেল চকচকে লাঠি আর হকিষ্ট্রিক দেখে ভরকে গেলেন রইচ উদ্দিন। সাংবাদিকের সাহায্য নিতে এসে রিমান্ডে পড়ে গেলেন নাকি? অস্বস্তি গোপন করতে পারছেন না তিনি। বিষয়টি টের পেয়ে কুদ্দুছ আবার বয়ান করে তার জারিজুরি।
‘শোনেন থানার ওসি আর ইউএনও সাবকে খবর দিলেই তারা আমার অফিসে ছুটে আসে। না এসে তাদেরতো কোন উপায় নাই। কুদ্দুছকে যারা মানতে চায়না তাদের কপালে খারাপি আছে। কয়েকদিন আগে সমবায় অফিসার আমাকে নিয়ে কটুকথা বলেছিল। পত্রিকায় তার করাপশন নিয়ে লিড নিউজ করেছি। এ নিয়ে বাড়াবাড়ি শুরু করলে রাস্তায় ধরে সাইজ করেছি। থানা—পুলিশের ভয় দেখিয়েছিল। বলেছি—যা ইচ্ছে করো। সাংবাদিক কী জিনিষ এইবার তোরে বুঝাব। ভয়ে আর থানামুখো হয়নি। দুনিয়াটা হচ্ছে —শক্তের ভক্ত নরমের যম’।
কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন রইচ উদ্দিন। তার আগেই আবার কথা বলতে শুরু করে কুদ্দুছ—
‘এই অফিসটা হচ্ছে খাজা বাবার দরবারের মতো। কেউ খালি হাতে ফেরেনা। কেস বুঝে সমাধান বাতলে দেই’
এরপর টেবিলের অন্য একটি ড্রয়ার থেকে একটি ব্যানার বের করলেন কুদ্দুছ। তাতে লেখা ‘সংবাদ সন্মেলন’।
‘শোনেন যে কোন অভিযোগ নিয়ে আমার কাছে কেউ এলে ব্যানার রেডি থাকে। পটাপট ছবি তুলে নিউজ করে দেই। হাতে হাতে কাজ। একা সামাল দিতে পারিনা বলে আপনাদের দোয়ায় আমার স্ত্রীকেও সাংবাদিক বানিয়েছি। উত্তরাধিকার সূত্রে পেশার মযার্দা ঠিক রাখতে ছেলেকেও সাংবাদিক বানবার নিয়ত করছি ইন্সাআল্লাহ’।
‘আমি খুব পেরেসানির মধ্যে আছি। একটা নিউজ করে দেন। আমার ছেলে কোথায় আছে জানতে চাই’। রইচ উদ্দিন অস্থির হয়ে যায়।
‘মুরুব্বি সব কিছুর একটা সমাধান আছে। তবে জানেনতো কাজ করতে গেলে খরচাপাতি লাগে। কিছু খরচ করলে আপনার ছেলেকে খুঁজে বের করা কোন অসম্ভব ব্যাপার হবেনা। মাওলানা সাবরা মিলাদ পড়িয়ে হাদিয়া নেন। আর সাংবাদিকরা খবর ছাপিয়ে পয়সা নিলেই দোষ?’
‘কোথায় আছে ছেলেটা জানতে পারলে ভাল হতো’— শামসুল আলম তার পূর্ব পরিচিত সাংবাদিক কুদ্দুছ প্রামানিকের কাছে অনুরোধ করেন একটা ব্যবস্থা নিতে।
‘শোনেন আমি এসপি সাহেবকে বলব— আপনি ভালো লোক। যদি আপনার হেফাজতে ছেলেটি থাকে তাকে অতি দ্রুত কোর্টে সোপর্দ করুণ। অন্যথায় তাকে খুঁজে বের করুন’। অনেকক্ষণ টানা কথা বলে হাফিয়ে উঠেছেন বলে মনে হলো বিশাল বপুর মালিক সাংবাদিক কুদ্দুছ। এবার একটু জিরিয়ে নিয়ে বলেন—
‘শোনেন কেউ গুম বা নিখোঁজ হলে খঁুজে বের করার দায়িত্ব পুলিশের। আপনারা থানায় একটি জিডি করে রাখতে পারেন’।
সাংবাদিক কুদ্দুছ প্রামানিকের সাথে কথাবাতার্ বলে তার হাতে কিছু হাতখরচের টাকা গঁুজে দিয়ে রইচ উদ্দিন আর শামসুল আলম চললেন থানার দিকে। থানায় পৌছে দেখা গেল কেমন যেন উত্তেজনার ভাব। ওসি মুন্সি কুতুব উদ্দিন তার কক্ষে। বাইরে প্রহরায় রয়েছেন একজন কনষ্টেবল। কক্ষে আপাতত কাউকে অ্যালাউ করছেন না তিনি। থানার ‘ক্যাশিয়ার’ হুরমুজ খান আর এসআই মনির হোসেন তার কক্ষে। ওসি সম্ভবত ‘রিমান্ডে’ নিয়েছেন তাদেরকে। তার তর্জন গর্জন শোনা যাচ্ছে। ভাবেসাবে বোঝা গেল— ক্যাশিয়ার মহোদয় ক্যাশ নিয়ে বিরাট ঘাপলা করেছেন।
থানায় আসলে ‘ক্যাশিয়ার’ নামে কোন পদ নেই। তারপরেও একজন অলিখিত ক্যাশিয়ার থাকে। হুরমুজ খান ক্যাশিয়ারের চলতি দায়িত্বে আছেন। বিভিন্ন ঘাট থেকে যে অর্থ আসতো তার জমা হতো তার কাছে। মাস শেষে পদবী অনুসারে তা বিলিবন্টন হতো। কিন্তু এ মাসে ক্যাশের সঠিক হিসাব মিলছে না। গত মাসের চেয়ে অর্ধেক টাকাই নেই। এ নিয়ে ওসির জেরার মুখে পড়ে বারকয়েক তোতলানোর পর এখন খামোশ হয়ে আছেন হুরমুজ।
আর মনির হোসেনের অপরাধ—তিনি গত রাতে বাংটুরঘাট এলাকা থেকে এক গাঁজা ব্যবসায়ীকে ধরে থানার আনার আগেই ৩০ হাজার টাকা দফরফা করে ছেড়ে দিয়েছেন। তার থানায় এ রকম গুরুত্বর করাপশন মেনে নিতে পারছেন না ওসি কুতুব উদ্দিন।
‘তুমি একটা বিরাট শয়তান। তোমার সব হাঁড়ির খবর আমি জানি। কনষ্টেবল নিয়োগের সময় দালালি কইর‌্যা অনেক মাল কামাইছ। পকেটে নাকি টেপ নিয়া ঘোর। আর বেকার ছেলেদের হাইট আর চেষ্ট মাপোজোগ করো। টেইলার মাষ্টার হইয়া গেছ। ব্যাটা তোমাকে খাগরাছড়ি বদলির ব্যবস্থা করতাছি’।
ঝাড়া এক ঘন্টা ওসির রুমে ‘রিমান্ডে’ থেকে চোখ লাল করে বেরিয়ে এলেন দু’জন। সার্ভিস লাইফে এমন ঝারি খেয়েছেন বলে মনে মনে হয়না।
কনষ্টেবলের অনুমতি নিয়ে ওসির রুমে ঢুকলেন রইচ উদ্দিন ও শামসুল আলম। ওসি তখনও ঝিম মেরে বসে আছেন। টেবিলে টুক টুক করে তাল দিচ্ছেন। গীত রচনা করছেন কীনা কে জানে?।
‘আপনারা আবার কী জন্যে এসেছেন। ছেলেকে খুঁজে পাননি?’
‘না। সে কারণে একটা জিডি করতে চাই’।
‘জিডি করতে চান করেন। মুন্সির কাছে চইল্যা যান। ভাল করে মুসাবিদা কইর‌্যা জমা দিয়া যান। দেখি কী করা যায়’।
থানার মুন্সি নামের কেরানীর কাছে গেলেন রইচ উদ্দিন। এখানে আবার মুন্সির ছড়াছড়ি। তো মুন্সির কাছে কিছু বকশিশ দিয়ে ভালোমতো মুসাবিদা করে জিডি জমা দিলেন তার হাতে। একটি রিসিভ করা কপি তাকেও দেয়া হলো। কাগজটি হাতে নিয়ে তারা বের হয়ে এলেন থানা থেকে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *