মোঃ রফিকুল ইসলাম, কুড়িগ্রাম জেলা প্রতিনিধি ঃ

উত্তরবঙ্গের বৃহত্তম ধর্মীয় একটি বিদ্যাপীঠের নাম সাতদরগাহ নেছারিয়া কামিল (এম এ) মাদরাসা। ইসলামের আলো ছড়িয়ে দিতে ১৯৪২ সালে কুড়িগ্রাম জেলার উলিপুর উপজেলার নিভৃত পল্লী সাতদরগাহ গ্রামে আব্দুন্নাছির পীর সাহেব কেবলা (রঃ)’র ঐকান্তিক শ্রম ও প্রচেষ্টায় স্থাপিত করেন ইসলামিক এই বিদ্যাপীঠটি। তৈরি হয়েছেন হাজারো আলেম, মুফতি, মোহাদ্দেছ, মুফাচ্ছির, বুজুরগান ও শিক্ষক। বিদ্যাপিঠটির প্রতিষ্ঠাতা আব্দুন্নাছির পীর সাহেব তাঁর জীবদ্দশায় মাদ্রাসাটিকে নিজের সন্তানতুল্য বলে পরিচয় দিতেন। ফলে অল্প দিনের মধ্যে পীর সাহেবের প্রচেষ্টা ইসলাম প্রিয় মানুষজনের দানে মাদরাসাটি উত্তরবঙ্গের মধ্যে বৃহৎ ও ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি পায়। এক পর্যায়ে আল্লাহ্ভীরু ধর্মপ্রাণ মানুষজনের দানে মাদরাসার সম্পত্তির পরিমাণ ১শ একরেরো অধিকে পরিণত হয়। শুধু তাই নয় ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা তাদের মনস্কামনা পূরণের জন্য এই প্রতিষ্ঠানের নামে অকাতরে দান করেন যা এখনো অব্যাহত আছে। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি অনুদান প্রাপ্তির পূর্বে মহীরুপে পরিণত হয়েছিল। সেই বিদ্যাপীঠটি আজ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে।

জানা গেছে, পীর সাহেব কেবলার জীবদ্দশায় ১লা আগষ্ট ১৯৮১ইং সালে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন মাওঃ মতিউর রহমান। ১৯৯১ সালে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান ইসলামী ঐক্যজোটের প্রার্থী হিসেবে মিনার প্রতীক নিয়ে জাতীয় সংসদ সদস্য পদে নির্বাচন করে হেরে যান। এরপর শুরু হয় দলাদলি। ধ্বংসের দিকে যেতে থাকে সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানটি। ২০০১ইং সালে অধ্যক্ষ মতিউর রহমান জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অধ্যক্ষ মতিউর রহমান (এমপি) হওয়ায় তিনি সহ তার শ্যালক মোহেব্বুল হাসান করিমীর সাথে দ্বন্ধের কারণে বিতাড়িত হন খ্যাতিয়মান শিক্ষক মাওঃ মোহাম্মদ আলী, মাওঃ লুৎফর রহমান, মাওঃ মুহসিন আলী, মাওঃ আঃ কুদ্দুছ ও পীর সাহেব কেবলা (রঃ) সহ মাদরাসার হিতাকাংখি ও শুভাকাঙ্খীরা। এ ক্ষোভে পীর সাহেব উলিপুরে এসে তার ছেলে মমতাজুল হাসান করিমীর বাসায় অবস্থান করা কালে মৃত্যুবরণ করেন। এরপর অবস্থা আরো জটিল আকার ধারণ করে। অধ্যক্ষ মতিউর রহমান জাতীয় সংসদ সদস্যের প্রভাব খাটিয়ে মাদ্রাসার সম্পত্তি বিক্রি শুরু করেন। দেখতে দেখতে মাদ্রাসার নিজ নামীয় ৫৪ একর ৩৭ শতক জমি বিক্রি করেন। এদিকে ২০০৮ইং সালে ৩১ আগষ্ট অধ্যক্ষ মাওঃ মতিয়ার রহমান (সাবেক সংসদ সদস্য) অধ্যক্ষ পদ হতে অবসর গ্রহণ করেন। ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন মাওঃ মোশাররফ হোসেন। প্রতিষ্ঠানের আর্থিক কেলেঙ্কারীর অভিযোগে তাঁকে অব্যাহতি দিয়ে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে মাওঃ আঃ রাজ্জাকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। বিভিন্ন কারণে তিনি ও দায়ভার ছেড়ে দেন। অতঃপর মাওঃ ফখরুল ইসলামকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। সবই চলছিলো নির্ধারিত ছক কষে। নির্ধারিত ছকে পত্রিকায় নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হলে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ নিজেকে অধ্যক্ষ হিসেবে জিতিয়ে আনতে সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। নিয়ম অনুযায়ী অধ্যক্ষ পদপ্রার্থী হওয়ায় তাঁকে ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষের পদ ছাড়তে হলো। জানা গেছে, উক্ত অধ্যক্ষ পদে চাকুরি পেতে চতুর ওই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ৪ জন প্রার্থীর মধ্যে মাওঃ আবুল কাশেমকে প্রক্সি প্রার্থী হিসেবে নিয়ে আসেন ওই ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ। কিন্তু বিধি বাম। নিয়ম অনুযায়ী নিয়োগ পরীক্ষায় ৪ জন প্রার্থীর মধ্যে পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করনে, বর্তমান অধ্যক্ষ মাওঃ আবুল কাশেম। ২য় এবং ৩য় হন রংপুরের দুইজন প্রার্থী, ৪র্থ স্থানে থাকেন ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মাওঃ ফখরুল ইসলাম। উল্লেখ্য নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণকারী ৪ জন প্রার্থীর মধ্যে শিক্ষা সনদে ৩ জন প্রার্থীর ২ টিতে প্রথম শ্রেণি, বর্তমান অধ্যক্ষের ছিলো ৩ টিতে প্রথম শ্রেণি। গত ৭ই মার্চ ২০১২ইং সালে বর্তমান অধ্যক্ষ মাওঃ আবুল কাশেম প্রতিষ্ঠানটিতে অধ্যক্ষ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন। এতে মাওঃমতিয়ার রহমান ( সাবেক অধ্যক্ষ ও সাবেক এমপি) ক্ষিপ্ত হয়ে এই নিয়োগকে চ্যালেঞ্জ করে সাতদরগা বালিকা মাদরাসার শিক্ষক সাবেক অধ্যক্ষ’র শ্যালক মাওঃ মুহেববুল হাসান করিমীকে দিয়ে আদালতে মামলা দায়ের করেন যার নং (অন্য ৭৫/২০১২)। এটাই ছিলো বৃহৎ ঐতিহ্যবাহী সাতদরগাহ নেছারিয়া কামিল (এম এ) মাদ্রাসার বিরুদ্ধে প্রথম মামলা। এরপর সাবেক ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ফখরুল ইসলাম, মাওঃ মোশাররফ হোসেন ও প্রতিষ্ঠানে কর্মরত বাংলা প্রভাষক মাইদুল ইসলাম প্রতিষ্ঠানের গভার্ণিং বডির বিরুদ্ধে এক এক করে আদালতে ১২টি মামলা দায়ের করেন। বিজ্ঞ আদালতে মামলাগুলো মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় খারিজ করে দেয়। এলাকার সর্বসাধারণ মানুষ মিছিল সহকারে নব-নিযুক্ত অধ্যক্ষকে মাদ্রাসা অফিসে বসিয়ে দেন। অধ্যক্ষ নিয়োগ প্রাপ্তির পূর্বেই ২০১০-২০১২ইং সালে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালনকারী আব্দুন্নাছির পীর সাহেব কেবলা (রঃ) ছেলে মাওঃ মমতাজুল হাসান করিমী প্রতিষ্ঠানের হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের জন্য কমিটি গঠন সহ ইসলামিক ইউনিভার্সিটি কুষ্টিয়ায় যোগাযোগ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় প্রতিষ্ঠানের হৃত সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের পথ অনেকটা এগিয়ে যায়। ওই সময়ে ফাজিল কামিল মাদরাসা নিয়ন্ত্রণকারী ইসলামিক ইউনিভার্সিটি কুষ্টিয়ার প্রতিনিধিদল প্রতিষ্ঠানের ৫৪ একর ৩৭ শতক জমি বেআইনী ভাবে হস্তান্তরিত হয়েছে বলে মন্তব্য করত জেলা প্রশাসক কুড়িগ্রামকে তা পুনরুদ্ধারে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আদেশ দেন। উল্লেখ্য, ২০১২ইং সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি কুষ্টিয়ার প্রতিনিধিদল প্রতিষ্ঠানের তদন্তে আসার পূর্বে সাবেক অধ্যক্ষ মাওঃ মতিউর রহমান মাদরাসা অফিসে রক্ষিত মাদরাসার যাবতীয় কাগজপত্র নিজের বাড়িতে নিয়ে যান। প্রতিবেদনে বিষয়টি উল্লিখিত হয়েছে। মামলার কারণে কমিটির নিয়মিত কার্যক্রম না থাকায় মাদ্রাসার জরুরী সংস্কার কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। কর্মচারীর অনেকগুলো পদ শুন্য থাকায় প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হলেও কমিটির বিরুদ্ধে মামলা থাকায় নিয়োগ প্রদান সম্ভব হচ্ছে না।

#

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *