তাজিদুল ইসলাম লাল, রংপুর

রংপুর মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল (রমেক)এ ত্রি-মুখী দ্বন্দ্বে হ-য-ব-র-ল অবস্থা তৈরি হয়েছে। এখানে ডাক্তার, নার্স ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের মধ্যে দ্বন্দ্বে চিকিৎসা কার্যক্রমের বেহাল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। আবার চিকিৎসা সেবার নামে সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে রোগী ভর্তিসহ পদে পদে টাকা নেয়া হচ্ছে। সার্বিক বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত্ম বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ না করার কারণে দিন দিন উচ্ছৃঙ্খল হয়ে উঠছে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের সিন্ডিকেটটি। নতুন পরিচালকের যোগদানের পর থেকে গত দু’মাসে সিন্ডেকেটটির নৈরাজ্যমূলক কর্মকান্ডে সাংবাদিক, ডাক্তার, নার্স, রোগীসহ স্বজনদের লাঞ্ছিত ও আহত করার কমপক্ষে ১২টি ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় আর্থিক সুবিধা থাকায় উর্ধ্বতন কর্মকর্তার পক্ষপাতমূলক আচরণে তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠছেন।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, এক হাজার বেডের রমেক হাসপাতালটি উত্তরাঞ্চলের একমাত্র সর্ববৃহৎ হলেও এখানে রোগী থাকেন গড়ে তিন থেকে চার হাজার। প্রতিদিনেই এখানেই রংপুর বিভাগের ৮ জেলা থেকে উন্নত চিকিৎসা নিতে আসেন নিম্ন আয়ের সাধারণ মানুষজন। কিন্তু হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ভর্তি থেকে শুরু প্রতিটি পদে পদে হতে হয় নাজেহাল। ভর্তি ফি বাবদ ২৫ টাকা নেয়ার নিয়ম থাকলেও তা নেয়া হচ্ছে ৫০ থেকে ২শ ৫০টাকা পর্যন্ত। আবার মুমুর্ষ রোগীদের ওয়ার্ডে নিয়ে যেতে ২শ থেকে ৩শ ৫০ টাকা, এরপর মেঝেতে জায়গা পেতেও দিতে হয় টাকা, তবে রোগীর বেড পাওয়া মানে সোনার হরিণ। এগুলো ঝামেলা থেকে উদ্ধার হতে না হতেই ওষুধ ও টেষ্ট বাণিজ্য শুরু হয়ে যায়। এসব ঘটনা নিত্যদিনের হলেও পারস্পরিক যোগসাজশ থাকায় রোগী ও স্বজনরা ঝামেলা থেকে রেহাই পাচ্ছে না। এসব বিষয়ে কথা হয়, হাসপাতালে ভর্তি থাকা কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার মধুর হাইল্যা গ্রামের রফিকুল ইসলাম, লালমনিরহাটের সাহেবপাড়া গ্রামের আলী আকবর, রংপুরের তারাগঞ্জের সোহেল রানা।
সুত্র মতে, ২০১৬ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রমেক হাসপাতালের ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী মোখলেছুর রহমান খুন হন। এ খুনের ঘটনায় মামলা হয়। যার নং ২২, জিআর নং ৭৫৭/১৬। এ ঘটনায় হাসপাতালের কর্মচারী আশিকুর রহমান নয়নসহ কয়েকজনকে আসামী করে হত্যা মামলা দায়ের করেন নিহতের স্ত্রী। পরবর্তীতে চার্জশীটে নাম থাকায় নয়নকে বরখাস্ত করা হয় হাসপাতাল থেকে। এ ঘটনার পর থেকে আরও বেপরোয়া হয়ে উঠে সে। পেশী শক্তির বলে হাসপাতালের সব ধরনের উন্নয়নমূলক কাজ যেমন, ডাক্তারদের রুম মেরামত, ডাষ্টবিন পরিস্কার, এসি মেরামত, হাসপাতাল ফ্রিজ, স্ট্যান্ড ফ্যান্‌, সিলিং ফ্যান, মাঠের গাছ বিক্রি, বিভিন্ন রিপিয়ারিং কাজ, বিদ্যুৎ সংস্কার, ব্লাড ব্যাংক, জরুরী বিভাগ, পুলিশের কেসের ডেড বডি, ৫ম তলার পত্তর শাখা, সাধারণ কর্মচারীদের হয়রানীমূলক বদলি, সরকারি গাড়ী ব্যবহারসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণে নেয় সে। এগুলো থেকে প্রতি মাসে আয় হয় প্রায় অর্ধ কোটি টাকা। এর পাশাপাশি ঠিকাদারদেরদের সাথে হাত মিলিয়ে সবধরনের কাজ পাইয়ে দেয়ার বিষয়টি দেখভালো করে সে। হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত অন্য কোন ঠিকাদার সিডিউল ক্রয় বা জমা দিতে পারেনি।
হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন অভিযোগের প্রেক্ষিতে মহাখালী স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) ডাঃ শেখ মোহাম্মদ হাসান ইমাম স্বাক্ষরিত স্বাঃঅধিপ্রশা-২/৪র্থ শ্রেণী বদলী-৬১/ ঢাঃবিঃ/ ২০১৮/৪৯৬২/১(৯) নং স্মারকে রমেক পরিচালক বরাবর কঠোর ভাষায় অফিস আদেশ দেন। এতে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আশিকুর রহমান নয়নকে পঞ্চগড় সিভিল সার্জন এর নিকট বদলী করা হয়। কিন্তু নয়ন হাসপাতাল থেকে বরখাস্ত থাকায় বদলি কার্যক্রম পরবর্তীতে স্থগিত হয়ে যায়। তবে সে বরখাস্ত হওয়ার পর থেকে চাকরি বিধানাবলী না মেনে হাসপাতালের সকল ধরনের কাজের সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছেন। এর মধ্যে হাসপাতালের কোন অনুষ্ঠান হলে আর্থিক বিষয়গুলো সে দেখভালো করেন এবং এর পাশাপাশি নতুন পরিচালকরা যোগদান করলে বাড়ির এসিসহ সার্বিক সুবিধাগুলো সে দিয়ে থাকেন। এ কারণে পরিচালকরা তার প্রতি দুর্বল।
নাম প্রকাশ না করার স্বার্থে কয়েকজন কর্মচারী জানিয়েছেন, রমেক হাসপাতালটিতে নতুন পরিচালক আসলে ক’দিন পর থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়ে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের পক্ষ অবলম্বন করেন। একারণে তারা কোন কিছুকে তোয়াক্কা করে না। রোগীসহ স্বজনদের নাজেহাল, সাংবাদিক, ডাক্তার ও নার্সদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরণসহ সন্ত্রাসীমূলক কার্যক্রম চালিয়ে যান।
জানা গেছে, চলতি বছরের জুলাই মাসের মাঝামাঝি সময়ে পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন শরিফুল হাসান। তাঁর যোগদানের পর ৩০ জুলাই কালের কণ্ঠের ফটোসাংবাদিক নার্সদের অফিস রুমে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্নের বিষয়ে তথ্য নিতে গেলে ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারী আশিকুর রহমান নয়ন, অক্সিজেন বাবু, হামিদুল ইসলামসহ অনেকেই তাকে টেনে হেঁচড়ে এলোপাথারি কিলঘুষি মারে এবং ক্যামেরা ছিনিয়ে নিয়ে ধারণকৃত ছবি মুছে ফেলে। এঘটনায় লিখিত অভিযোগসহ মেট্রোপলিটন কোতয়ালী থানায় জিডি করেছেন ওই ভুক্তভোগী সাংবাদিক। যার নং ২১৩০, তারিখ ৩০.৭.২০২২।
চলতি বছরের ১৪ সেপ্টেম্বর হাসপাতালের এমআরআই, আল্ট্রাসনোগ্রাম ও ইসিজি কক্ষে রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের ঘটনা ঘটে। এতে মূল্যবান যন্ত্রপাতি ও মেশিনের ক্ষতি হয়। পরের দিন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল যে, ওই রুমে মেশিনপত্রগুলো ছিল অত্যন্ত নিম্নমানের। এগুলো নিয়ে বিভিন্ন সমালোচনা থাকায় একটা বিশেষ মহলকে বাঁচাতে এটি ঘটানো হয়েছে। তবে পরিচালকসহ কেউ এবিষয়ে মুখ খুলেনি। তবে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা এসে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনলেও পরবর্তীতে তদন্ত না হয়ে ধামাচাপায় পড়ে আছে রহস্যজনক অগ্নিকান্ডের ঘটনাটি।
গত ১৫ সেপ্টেম্বর হাসপাতাল থেকে গোপনে দিনে-দুপুরে রোগীবাহী ট্রলিতে করে স্টোর রুম থেকে সর্দার অফিসের কথা বলে ৪৫ টি চেয়ার, ২টি আলমারী, ৩টি কেবিনেটসহ অন্যান্য সামগ্রী তাপস দাস নামের এক ব্যক্তি ওয়ার্ড মাস্টার হাসানের বাসায় নিয়ে যাওয়া সময় সন্দেহ হলে আটক করেন হাসপাতালের উপ-পরিচালক ডাঃ আব্দুল মোকাদ্দেম। তবে এঘটনায় বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের কথা মিডিয়ায় প্রকাশিত হলেও ২ লাখ টাকায় রফাদফা হওয়ায় আর এগোয়নি।
৫ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে সিনিয়র স্টাফ নার্স ও নার্সেস এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আশরাফুল ইসলাম শামীম ও তার পরিবারকে বাসায় অবরুদ্ধ করে প্রাইভেট কার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়। এতে গ্যারেজটির প্রচুর ক্ষতি হয়। এঘটনায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধনসহ দোষীদের গ্রেফতারে ২৪ ঘন্টার আল্টিমেটামসহ কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা করলেও তদন্ত কিংবা কোন ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। এঘটনাতেও থানায় জিডি হয়েছে।
সর্বশেষ চলতি মাসের ২১ সেপ্টেম্বর রমেক হাসপাতালের অর্থোসার্জারি বিভাগের জুনিয়র কনসালট্যান্ট এ বিএম রাশেদুল আমীর তার অসুস্থ মাকে হাসপাতালে ভর্তি, সিসিইউতে স্থানান্তরসহ ৩ধাপে বকশিশ দিতে দালাল ও ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের। পরে ঘটনাটির বিষয়ে পরিচালক বরাবর লিখিত অভিযোগে ‘মানসিক পীড়াদায়ক ও অপমানজনক’ বলে উল্লেখ করেন তিনি। এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রোনিক্স মিডিয়া ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। পরে দুইজন পরিচ্ছন্নতাকর্মীকে বহিস্কারসহ তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। ঘটনাটি খুব আলোচিত ও সমালোচিত হলেও বর্তমানে ডাক্তারদের সাথে অসৌজন্যমূলক আচরন করছেন ওই ৪র্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা। তাদের সভা, সেমিনারসহ প্রতিটি পদক্ষেপে ব্যাঘাত সৃষ্টি করা হচ্ছে।
রমেক হাসপাতালের ৪র্থ শ্রেণী কর্মচারীদের নেতা আশিকুর রহমান নয়ন জানান, আমাকে নিয়ে অভিযোগগুলো ষড়যন্ত্রমূলকভাবে করা হচ্ছে। সকল কর্মচারীসহ হাসপাতালটির আমি ভালো চাই, এজন্য কাজ করে যাচ্ছি।
সিনিয়র স্টাফ নার্স ও নার্সেস এসোসিয়েশনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আশরাফুল ইসলাম শামীম জানান, প্রাইভেট কার আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়ার পর হাসপাতাল পরিচালকের সাথে যোগাযোগ করি, তারা এ বিষয়ে কোন দায়িত্ব না নিয়ে মামলা করতে বলেন। আমি পরে অজ্ঞাত আসামী দেখিয়ে থানায় মামলা করি। তবে তিনি কিছু কর্মচারীদের ইন্ধনে সুরক্ষিত ক্যাম্পাসে ভিতরে অগ্নিকান্ডের বিষয়ে দুঃখ করে বলেন, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কোনভাবেই এর দায় এড়াতে পারে না।
সার্বিক বিষয়ে রমেক হাসপাতালের পরিচালক শরিফুল হাসান জানান, আমি সবগুলো ঘটনার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়েছি। এরই ডাক্তারের মাকে ভর্তি তদন্ত কমিটি কাজ করছে এবং কোয়াটারে গাড়ীতে আগুন লাগার বিষয়টি পুলিশ তদন্ত করছে। অন্যান্য বিষয়গুলো নিয়ে কথা বললে তিনি উত্তিজিত হয়ে বলেন, অফিসে আসেন সাÿাতে কথা হবে।
রংপুর মেডিকেল কলেজের অধ্যÿ ডা. বিমোল চন্দ্র বর্মন জানান, চিকিৎসা ব্যবস্থায় দীর্ঘ দিন থেকে হাসপাতালটিতে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি চলে আসছিল। তাছাড়া কর্মচারীরা ডাক্তারদের সাথে বিভিন্ন সময় খারাপ আচরণের ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, সার্বিক ঘটনার প্রেক্ষিতে ২৪ সেপ্টেম্বর ১০৩জন শিক্ষকের উপস্থিতি ১১সদস্য বিশিষ্ট স্বাস্থ্যসেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা উন্নয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনী থেকে পরিচালক নিয়োগসহ বিভিন্ন দাবিতে সোমবার মানববন্ধন ও সমাবেশ করা হয়েছে। পরিস্থিতি স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত এ আন্দোলন পর্যায়ক্রমে চলবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *